Ajker Patrika

পলিথিনে পরিবেশ বিপর্যয়

মৃত্যুঞ্জয় রায়
পলিথিনে পরিবেশ বিপর্যয়

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই হাতে বাজারের থলে আর খালুই উঠেছিল। ফ্রিজ কি জিনিস তা জানতাম না। তাই রোজই খাওয়ার জন্য বাজার করতে হতো। সকাল হলেই এক হাতে সেই চটের থলে, অন্য হাতে বাঁশের খালুই। এই প্রজন্ম তো এর সঙ্গে পরিচিত নয়। থলেকে ‘ব্যাগ’ হিসেবে চিনলেও ‘খালুই’ চিনবে না অনেকেই। বাঁশের বেতি তুলে জালের মতো বোনা প্রায় গোলাকার একটা পাত্র হলো খালুই, একটা হাতল বা দড়ি লাগানো থাকে মুখের কাছে। তাজা-মরা মাছ বহনের জন্য তা ব্যবহৃত হতো। এর অস্তিত্ব এখন গ্রামেও দেখা যায় না। 
এখন আমরা বাজারে যাই খালি হাতে। এটা-সেটা কিনি। দোকানিরা সবই ভরে দেন পলিথিনের ব্যাগে। একেক পদের জন্য একেক সাইজের ব্যাগ। অবশেষে অনেকগুলো পলিথিনের ব্যাগ হাতের মুঠোয় ধরে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথ ধরি। বাজারের সওদাগুলো বের করেই পলিথিনগুলো ফেলে দিই এখানে-সেখানে কিংবা বর্জ্যের ঝুড়িতে। বর্জ্যের ঝুড়ি থেকে সেগুলো চলে যায় পৌর ভাগাড়ে। ভাগাড় থেকে সেগুলো স্তূপ করা হয় শহরের কাছাকাছি কোনো নিচু জমিতে। এরপর সেগুলো সেখানে পচে। আশপাশে পচনের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশকে অস্বস্তিকর করে তোলে। পাখি ও প্রাণীরা সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশপাশ নোংরা করে তোলে। রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, তবু সেই সব পলিথিন মাটিতে মেশে না।

আমরা কুমড়োর খোসা থেকে ভাঙা কাচ ও পলিথিন—সবই ফেলি এক পাত্রে। বিদেশে জৈব আর অজৈব, নরম ও কঠিন বর্জ্য বাড়িতেই আলাদা পাত্রে রাখার নিয়ম রয়েছে। সে জন্য দুই ধরনের বর্জ্য চলে যায় দু ধরনের বর্জ্য শোধনাগারে। সেখানে জৈব বর্জ্য যেমন বাসাবাড়ির তরকারির খোসা, হাড্ডি, ভাগাড়ের উচ্ছিষ্ট, ফলমূলের আবর্জনা ইত্যাদি চলে যায় জৈব সার তৈরির জায়গায়। আর কঠিন বর্জ্য আলাদাভাবে রিসাইক্লিং করা হয়। সবকিছুই করা হয় নির্দিষ্ট স্থানে যন্ত্রের দ্বারা, পরিবেশসম্মতভাবে। সম্প্রতি আমাদের দেশেও বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের চেষ্টা চলছে, প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে ঢাকার অদূরে আমিনবাজারের কাছে। কিন্তু সেখানে পলিথিন কি যাবে? 
পলিথিন আসার আগে যদি মানুষের জীবন পলিথিন ছাড়া চলত, এখন কেন সেটা এত বেশি দরকার হয়ে পড়ল? 
 
পলিথিন কেন দরকার
আশির দশকের শুরুতে ১৯৮২ সালে যখন বাংলাদেশে প্রথম পলিথিন এল, তখন মানুষের আধুনিকতার বাসনায় যেন কর্পূরের মতো উবে গেল চটের থলে ও কাপড়ের ব্যাগ। সহজে বহন করা ও সুলভ হওয়ায় হাতে ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ হলো। একটা থলে নিয়ে বাজার করতে গেলেই লজ্জা হচ্ছে? এই লজ্জার হাত থেকে রেহাই দিতে আমাদের ঘরে-বাইরে সর্বত্র এখন পলিথিনকে সঙ্গী করে নিয়েছি। এতে চটের থলের ও বস্তার ব্যবহার কমে যাওয়ায় সর্বনাশ ঘটেছে পাটশিল্পেরও।

আগে ছোট্ট মাটির পাত্রে নার্সারিতে চারা-কলম তৈরি করা হতো, এখন পলিব্যাগ ছাড়া তা চলে না। মাটির টবে চমৎকার করে আমরা ফুলগাছ লাগাতাম। এখন এসেছে প্লাস্টিকের টব। দই পাতার পাত্রটিও এখন আর মাটির নেই। এতে মৃৎশিল্পের বারোটা বেজেছে। নির্মাণশিল্পে ঢালাইয়ের কাজেও ঢুকে পড়েছে পলিথিন। তবে ভয়ালরূপে বিচরণ করছে বাজারে প্যাকিং দ্রব্য বা বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক হিসেবে পলিব্যাগের ব্যাপক ব্যবহার। আগে বাজারে খোলা লবণ বিক্রি হতো। পদ্ম বা শাপলা পাতায় মুড়ে দোকানিরা সেই লবণ ক্রেতাদের দিতেন। এখন সুদৃশ্য চকচকে রঙিন ছাপায় এসেছে পলিথিনের মোড়ক।

ষাটের দশকে সারের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর সেগুলো বিক্রি হতো চটের বস্তায়, চালও। এখন সেই সব চটের বস্তাকে হটিয়ে বিদায় করেছে পলিথিনের বস্তা। চাল, ডাল, চিনি, ময়দা আগে বিক্রি হতো কাগজের ঠোঙায়। এখন বিক্রি হয় পলিথিনের প্যাকেটে। তেলের জন্য কাচের শিশি বা বোতল নিয়ে বাজারে যেতাম। এখন প্লাস্টিকের বোতলে বা পলিপ্যাকে তেল ভরাই থাকে। এভাবে চারপাশে তাকালে সর্বত্র আমাদের চোখে পড়বে পলিথিনের ব্যাপক উপস্থিতি। এর প্রভাবে আমরাও আমাদের ভালো অভ্যাসগুলো খারাপ অভ্যাসে বদলে 
ফেলেছি এবং নিজের অজান্তে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করে চলেছি। 

ক্ষতি কী
কারখানায় তৈরি করা একধরনের রাসায়নিক তন্তুজাত দ্রব্য পলিথিন। অত্যন্ত বিষাক্ত ও ক্ষতিকর প্রোপাইলিনের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বনের তিন বা চারটি অণুর সংমিশ্রণে পলিথিন তৈরি হয়। পলিথিন এমন এক অসম্পৃক্ত রাসায়নিক যৌগ, যার অণুগুলো ব্যাগজাতীয় দ্রব্য তৈরির পরও কিছু কিছু বাহু মুক্ত অবস্থায় থেকে যায়। পলিব্যাগ বহন করা বা তার ভেতরে কোনো খাদ্যসামগ্রী রাখায় সেই সব খাদ্যসামগ্রী ও পলিথিনের সংস্পর্শে থাকা বহনকারীর অঙ্গগুলোর সঙ্গে সেই সব মুক্ত রাসায়নিক কণার বাহুগুলো মিলেমিশে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়। রোজ অল্প অল্প করে দেহে সেই সব বিষ প্রবেশ করে। অনেকটা ‘স্লো পয়জনিং’-এর মতো মানবদেহকে আক্রান্ত করে বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে, যার মধ্যে ক্যানসার উল্লেখযোগ্য। পাকস্থলী ও কিডনির বিভিন্ন সমস্যাও তৈরি হয় এর ফলে। 

এসব পলিথিন যদি পোড়ানো হয়, তবে তা থেকে অত্যন্ত বিষাক্ত হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়, যার ফলে বাতাস দূষিত হয় এবং সেই দূষিত বাতাস আমরা শ্বাসের মাধ্যমে টেনে নিই। হাইড্রোজেন সায়ানাইড মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়, এমনকি এতে ত্বকেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়। পলিথিন এমন সব রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে তৈরি করা হয়, যা আদৌ মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য সহায়ক নয়। পলিথিনের ভেতর থেকে ফেনল নামক একধরনের বিষাক্ত দ্রব্য নিঃসারিত হয়। তাই পলিথিনের ব্যাগে কোনো খাদ্য রাখলে সেগুলো সেই ফেনলের সঙ্গে মেশে। এটা বিষের মতোই।

রিসাইক্লিং না হওয়ায় পলিথিন আমাদের জমিগুলোতেই ছড়িয়ে পড়ছে। পলিথিন সহজে পচে না। যেখানে ফেলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে সেখানে পড়ে থাকে। এতে মাটিতে বাতাস চলাচল ও অক্সিজেনের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবেরা বাঁচতে পারে না।

মাটিতে অণুজীব না থাকলে জৈব পদার্থ ভাঙবে কারা, পচাবে কারা? এতে মাটির উর্বরাশক্তির স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে। শহরের নর্দমায় এগুলো জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। ফলে মশা বাড়ছে, মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। কোনো রকমে সেগুলো নর্দমার চৌহদ্দি পেরিয়ে খালে বা নদীতে পড়লে সেখানেও আবার পানিকে দূষিত করছে।

পলিথিন তৈরির জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে একধরনের সাবুদানার মতো গ্রানুল আমদানি করতে হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ছে। পলিথিন ব্যবহারের ক্ষতির কথা বুঝতে পেরে ইতিমধ্যে বিশ্বের ৮৭টি দেশে পলিথিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনে বিশ্বে দশম অবস্থানে রয়েছে। এমনকি পড়শি দেশ ভারতে আমাদের চেয়ে বেশি মানুষ থাকলেও মাথাপিছু সে দেশে পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে কম, বিশ্বে এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ১২তম, শীর্ষে রয়েছে চীন। 

করব কী
অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছ যে, একটা দিনও আমরা পলিথিন ছাড়া চলতে পারছি না। সরকার ২০০২ সালে সারা দেশে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে। এতে আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম, পাটশিল্প ও কাগজের ঠোঙার ব্যবহারও বেড়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে আবার আমরা সরে এসেছি। ২০১০ সালে সরকার আবারও ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু এতেও পলিথিনের ব্যবহার কমছে না। ২০১৫ সালে সরকার ধান, চাল, ভুট্টা, সার ও চিনি মোড়কের জন্য পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু বাজারে সেই বাধ্যতামূলক অবস্থার চিত্রটি দেখা যাচ্ছে না। তাই শুধু আইন করে নয়, আইনের প্রয়োগ দরকার।

একদিকে পলিথিনের কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে বিক্রেতার দোকানে অভিযান চালিয়ে তাকে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এরূপ দ্বিমুখী নীতি থেকে সরে আসতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জনসাধারণের মধ্যে পলিথিন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালাতে হবে।

পাশাপাশি প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের তথা পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থারও পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো আমদানিকারক আর পলিথিনের কাঁচামাল আমদানি করবেন না, কোনো কারখানাতেই আর পলিথিন উৎপন্ন হবে না, কোনো পলিথিন ব্যবসায়ী আর পলিথিন বেচবেন না, যখন আমরা সবাই মিলে পলিথিনকে ‘না’ বলব। পলিথিনকে ‘না’ বলতে না পারলে একদিন তা আমাদের চরম ভোগান্তি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ‘সন্ত্রাসী খেল’ ফাঁস করে দিলেন জঙ্গিগোষ্ঠী জইশের সদস্য

বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে আসিফ নজরুলের পুরোনো ফেসবুক পোস্ট নতুন করে ভাইরাল করলেন হাসনাত

বাংলাদেশসহ ৫ প্রতিবেশীকেই নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে ভারত

‘সোহরাব-রুস্তম’ সিনেমায় ইলিয়াস কাঞ্চনের নায়িকার জীবনের করুণ অবসান!

৫ ইসলামি ব্যাংকে বসছে প্রশাসক, একীভূতকরণে লাগবে দুই বছর: বাংলাদেশ ব্যাংক

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত