Ajker Patrika

গতির বেগতিক অবস্থা

মহিউদ্দিন খান মোহন
গতির বেগতিক অবস্থা

‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ বললে বাংলাদেশকে বোঝায়—এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে। দেশের এই দুই প্রান্তসীমাকে যূথবদ্ধ করে রাজনৈতিক স্লোগানও প্রচলিত আছে। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এখন যুদ্ধাশঙ্কায় নিপতিত। প্রতিবেশী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের গোলা প্রতিদিনই এসে পড়ছে বাংলাদেশ সীমানায়, অর্থাৎ টেকনাফে।

৭ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রগুলো জানিয়েছে, আগের দিন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অন্তত ৭০ জন জওয়ান আরাকান আর্মির প্যাদানি সহ্য করতে না পেরে সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছেন বাংলাদেশ সীমানায়। আমাদের বিজিবি তাদের নিরস্ত্র করে নিরাপত্তা হেফাজতে রেখেছে।

নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! মাত্র ছয় বছর আগে এই মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর বর্বরতার হাত থেকে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মিয়ানমারবাসী উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আজকে পালিয়ে এসে জীবন বাঁচানো মিয়ানমারের ওই সব সৈনিকের মধ্যে সেদিনের অত্যাচারী বাহিনীর কোনো সদস্য আছে কি না, জানি না। অপরাধের দায়ভার বোধকরি এভাবেই শোধ হয়। একদিন মিয়ানমার সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী ভিটেমাটিছাড়া করেছিল সে দেশের বৈধ নাগরিক রোহিঙ্গাদের। আজ তাদেরই দেশের আরেক শক্তি ‘আরাকান আর্মির’ মারের চোটে নাভিশ্বাস উঠেছে মিয়ানমার সরকারের। নির্মমতা, নৃশংসতার প্রতিবিধান প্রকৃতি এভাবেই করে থাকে।অছিলা হয় একেক সময় একেকটা।

মিয়ানমারের এই অস্থিরতার অবসান হোক, সে দেশের নাগরিকেরা তাদের অধিকার নিয়ে বসবাস করার অধিকার ফিরে পাক, আমরা তা-ই চাই। নিকট প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের এ ধরনের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ আমাদের জন্য অতীব অস্বস্তিকর ও উদ্বেগের। কেননা, এর অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে আঘাত করে। ২০১৭ সালে এমন পরিস্থিতিতে ‘মানবিকতা’র পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে গিয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে গলগ্রহ মেনে নিতে হয়েছে। ঘরপোড়া গরুর মতো তাই আবারও সে রকম সিঁদুরে মেঘ দেখে আমরা প্রমাদ না গুনে পারছি না।

আজকের আলোচনার মূল বিষয় অবশ্য টেকনাফ বা মিয়ানমার নয়। কথা বলতে চাচ্ছিলাম স্লোগানের দ্বিতীয় অংশ তেঁতুলিয়া নিয়ে। টেকনাফে বার কয়েক যাওয়ার সুযোগ হলেও উত্তর প্রান্তে বাংলাদেশের শেষ সীমানা তেঁতুলিয়ায় যাওয়া হয়নি। হঠাৎ করেই সেই সুযোগ এসে গেল। নাতনি ঐশীর বউভাতে যেতে হবে পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার এক গ্রামে। ভাতিজি মুক্তা ও জামাতা হাশেমের একান্ত অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো পঁয়ষট্টিতে পঁচিশের সাহস নিয়ে এই দূর যাত্রায় সোৎসাহে সাড়া দিলাম। বাহন রেলগাড়ি। ৩৪৬ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ ভ্রমণে ট্রেনই স্বস্তিকর বাহন, বললেন অনেকে। কিন্তু তখনো কি জানতাম কী নিদারুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে আমাকে!

টিকিট কাটা হয়েছিল ‘একতা এক্সপ্রেসে’র প্রথম শ্রেণির কামরায়। মোট ১৫ জন। যাত্রা ৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকাল সোয়া ১০টায়। সময়মতো গিয়ে উঠলাম ট্রেনে। ভাবলাম ‘৯টার গাড়ি কয়টায় ছাড়ে’ ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে কিছুটা বিলম্ব তো হবেই। কিন্তু না, ঠিক সোয়া ১০টা নাগাদ ট্রেন মহাশয় তার দেহ নাড়তে শুরু করলেন। তীব্র শব্দে হুইসেল বাজিয়ে চলতে শুরু করলেন তিনি। পাশের আসনে বন্ধু সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল। বাদবাকি ভ্রমণসঙ্গীদের বেশির ভাগ কিশোর-তরুণ। তাদের উৎসাহের অন্ত নেই।

কিন্তু এই উৎসাহ-আনন্দ যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিরক্তিতে পর্যবসিত হবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি, আমিও না। ধারণা ছিল যেহেতু এক্সপ্রেস ট্রেন, তাই খুব কম স্টেশন স্পর্শ করবে এবং গতিও হবে দুর্বার। কিন্তু হা হতোস্মি! আমাদের বহনকারী রেলগাড়ি মহোদয় কাউকে বঞ্চিত করতে রাজি নন। তিনি ছোট-বড় প্রতিটি স্টেশনে তার পদধূলি (এখানে হওয়া উচিত ‘চক্রধূলি’) দিতে লাগলেন। তার ওপর সামনে থেকে আসা ট্রেনকে সাইড দেওয়ার বিষয় তো আছেই।

আমরা বসেছিলাম ইঞ্জিনের দুটি বগির পরেই ‘ঘ’ চিহ্নিত কামরায়। আসনও খারাপ না। তবে দীর্ঘপথ ভ্রমণের ক্ষেত্রে তা অনুপযুক্ত।সান্তাহার আসার আগেই সূর্যদেব ঢলে পড়লেন পশ্চিম দিগন্তে। জ্বলে উঠল ট্রেনের কামরার ম্রিয়মাণ নিয়নবাতি। তবে সবগুলো নয়, অর্ধেক পরিমাণ। ট্রেনের বাতি প্রসঙ্গে পুরোনো আরেকটি কথা মনে পড়ছে। ১৯৮০ সাল। ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান সরকার।

জয়পুরহাটের আবদুল আলীম রেলমন্ত্রী। প্রতি ঈদেই তিনি নিজ বাড়িতে যান। সেবারও গেছেন। ট্রেনে বিনা টিকিটের রেলযাত্রীদের নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা চারদিকে। সমালোচনায় অতিষ্ঠ রেলমন্ত্রী ঈদের পরদিন নিজেই চড়ে বসলেন খুলনা-পার্বতীপুর লাইনের এক ট্রেনে। ধরে ফেললেন হালি দুই বিনা টিকিটের যাত্রী। সম্ভবত দৈনিক সংবাদ সে খবরের শিরোনাম করেছিল, ‘রেলমন্ত্রীর ঈদ শিকার’।

এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ট্রেনে বাতি জ্বলে না কেন? আবদুল আলীম বলেছিলেন, ‘আপনি আস্থা রাখতে পারেন, এর পর থেকে ট্রেনে বাতিও জ্বলবে।’ এক সাংবাদিক টিজ করলেন ‘মাননীয় মন্ত্রী, এই বাতি কি লালবাতি?’ চৌকস আইনজীবী-মন্ত্রীর চটপট জবাব, ‘রঙিন বাতি দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। আপাতত সাদা বাতিই জ্বলবে।’

রাতের ট্রেনে ঠিকঠাক বাতি জ্বলছে আমাদের জন্য, তা এক পরম পাওয়া। তবে সেই সব বাতির অর্ধেক পরিমাণ কেন চোখ বন্ধ করে রাখে, কর্তৃপক্ষই তা বলতে পারবে। তার ওপর বিনা টিকিটের যাত্রী-সমস্যার যে আজ অবধি সমাধান হয়নি, তার প্রমাণ পেলাম কিছুক্ষণ পরেই। কচ্ছপ-গতিতে চলা ‘একতা এক্সপ্রেস’ প্রতিটি স্টেশনে তাশরিফ এনে তার উদরপূর্তি করেই চলছিল।

নানা স্টেশন থেকে চড়ে বসা সাধারণ শ্রেণির যাত্রীদের অনধিকার প্রবেশে প্রথম শ্রেণির কামরার পরিবেশ হয়ে উঠল যন্ত্রণাদায়ক। তাদের কারও কাছে টিকিট আছে, কারও কাছে নেই। জয়পুরহাট-পাঁচবিবি পার হওয়ার পর এ নিয়ে বেধে গেল ফ্যাসাদ। তুমুল হট্টগোল। পুলিশ সদস্য যাঁরা ছিলেন, পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে একপাশে নির্জীব পুতুলের ন্যায় দণ্ডায়মান। কেউ কেউ ‘টিটিই কোথায়, টিটিই কোথায়’ বলে উচ্চ স্বরে চিল্লাফাল্লা করছিল। ভাবলাম আমাদের ছেলেপেলেরা আবার জড়িয়ে পড়ল না তো!

আসন ত্যাগ করে এগোতে থাকলাম দরজার দিকে। অর্ধেক বাতি জ্বলা ট্রেনের মৃদু আলোয় আমার গায়ের গাঢ় মেরুন কোটকে দেখাচ্ছিল কালো আর মাথায় শীতাক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কেনা একটি হ্যাটসদৃশ টুপিকে ওরা টিটিইর ক্যাপ ভেবে বলে উঠল, ‘ওই যে টিটিই সাব আসতেছে।’ আমি এগিয়ে যেতেই একদল যাত্রী কামরা ছেড়ে বেরিয়ে দুই কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের জায়গায় আশ্রয় নিল।

আমি বললাম, ‘যাঁদের টিকিট নেই, তাঁরা পরের স্টেশনে টিকিট কেটে নির্দিষ্ট কামরায় চলে যাবেন। আর ভুলেও কেউ প্রথম শ্রেণির দিকে পা বাড়াবেন না। আমি কিন্তু এই কামরাতেই থাকব।’ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধবশত তারা তা-ই করেছিল। কেউ আর আমাদের কামরায় আসেনি, ভেবেছে টিটিই সাব তো আছে। তারা তো জানত না, ওই কামরা ছেড়ে যাওয়ার উপায় আমার ছিল না। বলা হয় আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। আর সেদিন দেখলাম ট্রেনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে।

শম্বুকগতির একতা এক্সপ্রেস অবশেষে তার সর্বশেষ গন্তব্য পঞ্চগড় স্টেশনে গিয়ে যখন স্থির হলো, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত সোয়া ১২টা; অর্থাৎ ১৪ ঘণ্টায় যাত্রা হলো সমাপ্ত। রেলওয়ের হিসাব মতে, ঢাকা-পঞ্চগড়ের দূরত্ব ৩৪৬ কিলোমিটার; যা সড়কপথে ৪৩২ কিলোমিটার।

এই ৩৪৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে একতা এক্সপ্রেসের সময় লেগেছে ১৪ ঘণ্টা; তার মানে এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় পৌনে ২৫ কিলোমিটার। এক্সপ্রেস ট্রেনের কী অপূর্ব উদাহরণ! এটাই যদি হয় এক্সপ্রেস ট্রেন, তাহলে লোকাল ট্রেনের কী দশা?

পাদটীকা: এ নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। তাতে খুলনা থেকে স্নেহভাজন সারওয়ার মন্তব্য করেছে, ‘গতির বেগতিক অবস্থা।’ ওর মন্তব্যকেই রচনাটির শিরোনাম করা যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো ৬ মাসের আগেই চূড়ান্ত করার আশ্বাস

কবরস্থানে রেখে যাওয়া নবজাতক হঠাৎ নড়ে উঠল, হাসপাতালে ভর্তি

উপদেষ্টার সভায় শেখ মুজিব-হাসিনার ছবি!

১২ জেলায় বন্যার শঙ্কা, বৃষ্টি থাকবে কত দিন—জানাল আবহাওয়া অফিস

ছাত্রীকে ওড়না ছাড়া দেখতে চান অধ্যক্ষ, স্ক্রিনশট দিয়ে ব্যানার কলেজ গেটে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত