Ajker Patrika

ওষুধেও মরছে না ৯ শতাংশ জীবাণু: গবেষণায় তথ্য

রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০: ৫২
ওষুধেও মরছে না  ৯ শতাংশ জীবাণু: গবেষণায় তথ্য

দেশে প্রায় ৯ শতাংশ জীবাণু সব ধরনের ওষুধ (অ্যান্টিবায়োটিক) শতভাগ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে ‘সিউডোমোনাস’। এই জীবাণুটি মূলত হাসপাতালে পাওয়া যায়। এরপরই আছে ই-কোলাই। বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের নমুনা নিয়ে বছরব্যাপী পরিচালিত এক গবেষণায় এই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১ হাজার ১৪৯টি নমুনার মধ্যে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ নমুনার জীবাণু সব ধরনের ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।যেসব নমুনায় এই জীবাণু পাওয়া গেছে, তার ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশই ক্ষতস্থানের নমুনা। অন্যদিকে একাধিক ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া গেছে ২০ বছরের নিচে রোগীর মধ্যে ২৯ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ রোগী ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ। এসব রোগীর মধ্যে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশের অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণুপ্রতিরোধী ওষুধ গ্রহণ করার ইতিহাস আছে। তাদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ রোগীই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবাণুর ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠার অর্থ হলো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধক্ষমতা ফুরিয়ে যাওয়া। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে, এমন জীবাণুর কারণে মানবজীবন হুমকিতে পড়তে পারে। সাধারণ রোগেও মানুষের মৃত্যু হবে। চারপাশে প্রচুর ওষুধ থাকার পরও জীবন বাঁচানোর মতো ওষুধ মিলবে না।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। গবেষণার বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন ধরনের ক্লিনিক্যাল নমুনা থেকে প্রাপ্ত ওষুধপ্রতিরোধী রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া আলাদা করে তার জিনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণুপ্রতিরোধী ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা।

২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণায় ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও ৪টি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১৩ হাজার ৩৫০টি প্রাথমিক নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণার কো-ইনভেস্টিগেটর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা ইরিনা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গবেষণায় সব ধরনের ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া গেছে সিউডোমোনাস। এর পরই রয়েছে ই-কোলাই। এই গবেষণায় সবচেয়ে বেশি নমুনা নেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে। আমরা এখানে সেটাই দেখাতে চেয়েছি যে জীবাণুগুলো শতভাগ ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।’

গবেষণায় দেখা গেছে, অণুজীব সবচেয়ে বেশি ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ ছিল সিউডোমোনাসে। জীবাণুগুলোর মধ্য থেকে আয়ন টরেন্ট জিনোম সিকোয়েন্স দিয়ে দৈব চয়নের মাধ্যমে ৩২টি জীবাণুর টার্গেট জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করা হয়। গবেষণায় এমন ৩০ ধরনের ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণুর জিন পাওয়া গেছে, যেগুলো সব ধরনের ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এর অধিকাংশই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্য বিভাগে শনাক্ত করা হয়েছে।

 এর আগে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় দেখা যায়, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বেশ কিছু রোগের জীবাণুর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ঠিকমতো কাজ করছে না। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এএমআর সার্ভিল্যান্স হালনাগাদ গবেষণায় মোট ২৭ হাজার ৪৩৮ জন রোগীর বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৮ শতাংশ জীবাণুর মধ্যে সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা পাওয়া যায়। চলতি বছরে পরীক্ষায় ২৭৩টি নমুনার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ব্যাকটেরিয়ায় এক ধরনের রাসায়নিক এনজাইম শনাক্ত হয়, যা ব্যাকটেরিয়া নিজে তৈরি করে এবং যা অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতাকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমগ্র দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে প্রতিরোধী জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক শনাক্তকরণসহ একটি অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন প্রণয়ন করা সম্ভব, যা সর্বস্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জীবাণুর ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

গবেষণা কার্যক্রমে নমুনার ধরন ছিল একাধিক ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু এবং সব ধরনের ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু। এ ক্ষেত্রে ক্ষতস্থান, মূত্র, রক্ত, মল, এন্ডোট্র্যাকিয়াল অ্যাসপিরেট পুঁজ এবং অন্যান্য মাধ্যম থেকে পাওয়া নমুনা গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো এমন একটি অবস্থা, যা তখনই ঘটে, যখন কিছু ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এরা অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতেও অভিযোজিত হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে মানুষ বা পশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়।

আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সেরে যেত, এখন আর সেই অ্যান্টিবায়োটিকে তা সারে না বরং ক্রমেই বাড়তে থাকে। এসব রোগাক্রান্ত মানুষ বা পশু অন্য কারও উপস্থিতিতে হাঁচি-কাশি প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয় এবং তারাও একই রকম দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৫-২০ বছর আগেও টাইফয়েড চিকিৎসায় যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হতো, সেটি এখন আর কার্যকর হয় না।যক্ষ্মার চিকিৎসায় বেশ কয়েকটি ওষুধ ব্যবহৃত হয়, এর মধ্যে কয়েকটির প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। এ জন্য দেশে মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যান্স টিবির প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। আগে কোনো একটি অসুখে চিকিৎসকেরা যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার পরামর্শ দিতেন, এখন আর সেটি দিচ্ছেন না। এর মূল কারণ হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।

এ বিষয়ে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ইমেরিটাস বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, অ্যান্টিবায়োটিকের (অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের জন্য) প্রতিরোধক্ষমতা ফুরিয়ে যাচ্ছে। শিগগির বিশ্ব আরেকটি জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে, যা কোভিড-১৯ মহামারির তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত