Ajker Patrika

বাংলাদেশ অনেক ভালো

জাহীদ রেজা নূর রূপপুর (পাবনা) থেকে ফিরে
আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২১, ১৩: ৫৯
বাংলাদেশ অনেক ভালো

গ্রিন সিটির সামনে একটি বিকেল কাটিয়ে ফেরার পথেই একজন বলল, ‘কাল কিন্তু গ্রিন সিটির সামনের জায়গাটা অন্য রকম হয়ে যাবে। কাল হাটবার।’

কী নাম হাটের? নতুন হাট—সেটাও জানা হয়ে যায়। নতুন হাট যে আসলে নতুন নয়, সেটা বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হয় পরদিন পর্যন্ত। জনাকীর্ণ হাটের একেবারে কিনারায় যিনি বসে আছেন, তিনি জানালেন, এই হাট শুরু হয়েছে একাত্তরের আগে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের আগে যে নতুন হাটটি যাত্রা শুরু করেছিল, এখনো তা তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। তিনিই জানালেন, প্রতি রবি আর বুধবার এখানে হাট বসে।

গ্রিন সিটি লাগোয়া হাটে সবজি নেই। সেটা আছে রাস্তা পার হলে। এ দিকটা মাছে সয়লাব। বিলের মাছ, নদীর মাছ, চাষের মাছ। বাঙালির পাশাপাশি রাশানরাও মাছ কিনছেন। দরদাম হচ্ছে। এখানেও রুশ ভাষা বোঝেন দোকানিরা। দরদাম কানে এল। পাঙাশ মাছ কিনছিলেন দুই রুশি। এক কেজি ওজনের পাঙাশের দাম চাওয়া হলো ৩০০ টাকা। রুশি ভদ্রলোক মোবাইলের ক্যালকুলেটরে লিখলেন আড়াই শ। সঙ্গে সঙ্গে রাজি দোকানি।

এই হাটে ছাগল-খাসিও এসেছে অনেক। এগুলো পাইকারি দরে কিনে নিয়ে যান মহাজনেরা। আজ ছাগল বিক্রেতাদের মন খারাপ। তাঁরা কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি। একটা বড় খাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন জিয়া। নিজের বাড়ির ছাগল। ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু ১৫ হাজারের ওপরে দাম ওঠেনি।

একটু দূরেই এক রুশ নারী আর এক পুরুষকে দেখলাম মাছ কিনছেন। কানে এল কয়েকটি শব্দ: ‘আৎরুবিতে গোলাভু।’

আমার কাছে তা চেনা শব্দ, কিন্তু দোকানি কি এই কঠিন রুশ শব্দগুলোর অর্থ বোঝে? হ্যাঁ বোঝে। অবলীলায় কিশোরটি মাছটাকে পৌঁছে দিল যিনি কাটবেন, তাঁর হাতে এবং বাংলায় বলল, ‘কল্লাটা কাইটা আলাদা দিবেন।’

এবার আমি আর অপেক্ষা করতে পারি না। ওদের সামনে এসে দাঁড়াই। বলি, ‘আপনি রুশ ভাষায় বললেন মাছের মাথা কেটে দিতে। ছেলেটা বুঝে নিল!’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমরা বাজারে এলে একে অন্যকে বুঝি ভালো। বাঙালিরা অতি দ্রুত রুশ ভাষা শিখে নিয়েছে। আমরাও বাংলাটা একটু একটু শিখে নিয়েছি।’

-আপনার নাম কী?
-ইয়েভগেনি। আর ও হচ্ছে লারিসা। আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন, যেভাবে বলেছি, ঠিক সেভাবে মাছের মাথা কেটে দিচ্ছে। 
-কেমন লাগছে বাংলাদেশ?

-এখানে জীবন অনেক ভালো কাটছে। আমি তো অনেক দেশে গেছি। তুরস্ক গেছি। বেলারুশিয়া গেছি। এখন অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের একটু তুলনা করতেই পারি। বুঝতে পারছেন, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একটা পার্থক্য আছে, এখানে প্রচণ্ড গরম পড়ে। অবশ্য এই নভেম্বরে এসে এ দেশের আবহাওয়া আমাদের দেশের মতো হয়ে গেছে।

-আমাদের শীতকাল তোমাদের গ্রীষ্মকালের মতো। 
-তা অনেকটা সে রকমই! 
-বাংলাদেশ সম্পর্কে আগে কোনো ধারণা ছিল? 
-দুই বছর আগে যখন প্রথম আসি, তার আগে এই দেশ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি। এভাবেই বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনেছি।

-বাংলাদেশ সম্পর্কে যা ভেবেছেন, এসে কি সে রকমই দেখেছেন? মানে কল্পনার সঙ্গে দেশটির কি মিল আছে? 
ইভগেনি এবার স্পষ্ট উত্তর দেন, ‘না, মেলেনি। যে রকম ভেবেছি, তার চেয়ে অনেক ভালো এই দেশ। আমরা এখন যেখানে থাকছি, তা খুবই আরামদায়ক জায়গা। আমাদের নিজস্ব বাহনে প্রকল্প পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। রাশিয়ায় আমরা যেভাবে থাকি, এখানেও সেভাবেই থাকতে পারছি। সে রকম আরাম দেওয়ার চেষ্টার কমতি নেই।’

লারিসার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি তো কোনো কথাই বলছেন না!’ 
লারিসা হাসলেন। কিছু মানুষের চেহারা আছে, যা দেখলে মনে হয়, কষ্ট এদের মন ছুঁতে পারে না। লারিসা অনেকটা সে রকম মানুষ।

তাঁকে কিছু বলতে অনুরোধ করলে বললেন, ‘এই দেশের মানুষ খুব দয়ালু। খুবই খোলা মন। আপনারা আমাদের সাহায্য করছেন। আমরাও আপনাদের সাহায্য করছি।’

লারিসাকে ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো। লারিসা হাসলেন। বললেন, ‘এ জন্যই হয়তোবা আপনারা আমাদের বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছেন।’

-মাছ কীভাবে রান্না করবেন? 
-মাছের মাথা আলাদা করে উখা (মাছ দিয়ে একধরনের স্যুপ) রান্না করব। আর মাছগুলো ভেজে খাব।

বাজারে দেখা হয় আবদুল মালেকের সঙ্গে। তিনি মস্কোয় পড়াশোনা করেছেন। এখানে প্রকল্পে কাজ করতে আসেননি। এসেছেন প্রকল্পের সরবরাহকারী হিসেবে। অর্থাৎ কোনো কোনো কেনাকাটা তাঁর মাধ্যমে করা হয়।

-আমি এখানে চাকরি করি না। বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল সরবরাহ দিয়ে থাকি। চার বছর ধরে এখানে আছি। এখানে এসে দেখছি, রাশানদের সঙ্গে এখানকার জনগণের নিবিড় একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। রাশানরাও তো বড় মনের মানুষ। এখানকার লোকেরা হয়তো প্রথমে কৌতূহল নিয়ে দেখেছে, এখন একেবারে মিশে গেছে। এখন অনেক সময় দোভাষী লাগেও না রাশানদের। আর এখানে যে বাঙালিদের দেখছেন, বিশেষ করে দোকানদারেরা, চলার মতো রুশ বলতে পারেন। মজার ব্যাপার হলো, বহুদিন আগে ওই দেশে পড়াশোনা করেছি বলে অনেক শাকসবজির নাম ভুলে গেছি, এখানকার দোকানদারেরা সেগুলো ঠিকঠাকমতো রাশান ভাষায় বলতে পারেন। এখানে ভালো একটা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এখানে আগে যারা অন্যের খেতে চাষ করে খেত, এখন তারা মোটরসাইকেল নিয়ে ঘোরে।

এই হাট ছেড়ে একটু এগোলে ফ্রোজেন মাছের দোকান। ‘গ্লোরিয়াস ফিশ’ নামের দোকানটিতে নানা ধরনের ফ্রোজেন মাছ পাওয়া যায়।

সাইনবোর্ডে রুশ ভাষায় অবশ্য লেখা রয়েছে ‘মস্কোভ্স্কায়া রিবা’ অর্থাৎ ‘মস্কোর মাছ’। চিংড়ি, স্যামন, কালমিরিসহ নানা ধরনের যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে এখানে, সেগুলো যেন রুশিদের নিজের দেশের একটা আস্বাদ এনে দিচ্ছে। আছে ঝিনুক। এটাও প্রিয় খাবার।

নতুন হাট সন্ধ্যা পর্যন্ত সরগরম থাকে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করে দুপুরের খাবারের সময় যখন গ্রিন সিটিতে ফিরে আসেন রাশানরা, তখন তাঁরা এই বাজারে একটু ঢুঁ মেরে যান। আবার রাত আটটার দিকেও এই এলাকার রেস্তোরাঁ বা ফাস্টফুডের দোকানগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে রুশদের আগমনে। সে সময় নিয়নের আলোয় সত্যিই মনে হয়, এ বুঝি কোনো এক রূপকথার রাজ্যে এলাম! 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা–ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

ভারত–বাংলাদেশ বাণিজ্য বিধিনিষেধের মূল্য গুনছেন ব্যবসায়ীরা

সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকেরা পাচ্ছেন গেজেটেড মর্যাদা

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আরেকটি প্রক্সি ওয়ারে জড়াতে চায়: ফরহাদ মজহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত