Ajker Patrika

পরেশের খোঁজে

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
পরেশের খোঁজে

অনেক দিন পর দিনাজপুর যাচ্ছি। উদ্দেশ্য পরেশ মেলা। দিনাজপুরের গোলাপগঞ্জে তার বাড়ি। যুবক পরেশ দুর্ঘটনায় নিহত হয় বেশ আগে। সে ছিল ওই অঞ্চলের এক অসাধারণ পালাটিয়া শিল্পী। পালাটিয়া ওই অঞ্চলের এক লোকনাট্য আঙ্গিক। সংগীত, অভিনয়, নৃত্য সবটা মিলিয়ে গণমানুষের একটা প্রিয় শিল্প। পরেশ বাজাতে পারত, গাইতে পারত এবং নারী চরিত্রে অভিনয় করতে পারত। দিনাজপুরের এক প্রগতিশীল যুবনেতা এবং অভিনয়শিল্পী মঈনুদ্দিন চিশতী পরেশকে নিয়ে দল গঠন করেছিল এবং ওই অঞ্চলের সর্বত্র পালাটিয়া গেয়ে বেড়াত। পরেশ মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী এবং তিন সন্তানের দায়দায়িত্ব সে পালন করত। সেই এলাকার মানুষজনদের নিয়ে প্রতিবছরই

২৯ নভেম্বর পরেশ মেলার আয়োজন করে। অনেক দিন ধরেই তা চলে আসছে। ইতিমধ্যে দুরারোগ্য রোগে চিশতীও চিরবিদায় নিয়েছেন। কিন্তু পরেশ মেলা চলছে।দিনাজপুর বাংলাদেশের এক প্রান্তিক শহর হলেও ওই এলাকার ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, পাঁচবিবি, ফুলবাড়ী,

পার্বতীপুর সর্বত্রই শিল্প-সাহিত্যের এক চর্চা গড়ে উঠেছিল। অবিভক্ত বাংলার হিলি, বালুরঘাট নিয়েও একটা কেন্দ্র ছিল দিনাজপুর। দিনাজপুরের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে সাঁওতাল, ওঁরাও, মাল পাহাড়িসহ বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একটা ভিন্ন সংস্কৃতি আছে। তাদের উৎসবও আলাদা। অত্যন্ত বর্ণাঢ্য এসব আয়োজন সারা বছর ধরেই চলতে থাকে। বাঙালি ও ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীদের সমন্বিত কিছু উৎসব আয়োজনও হয়ে থাকে। এই আয়োজনে সবাই একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। আমরা উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানের কথা জেনে আসছি। আব্বাসউদ্দীন এই গানের একটা সর্বভারতীয় রূপও দিয়েছিলেন। অদূরে নীলফামারীতেও সংস্কৃতির আরও একটি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। হরলাল রায় এবং তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ রায় ভাওয়াইয়া গানের একটা জনপ্রিয় রূপ সৃষ্টি করেছিলেন। দিনাজপুরের নাট্য সমিতি বহু যুগ আগে থেকেই নাটকের একটা আধুনিক চর্চা গড়ে তুলেছিল।

পরবর্তীকালে নবরূপীর শাহজাহান শাহ ও অভিনেতা সাজেক রানা জাতীয় ক্ষেত্রেও একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই এলাকাটি রেলওয়ের এলাকা। যেখানেই রেলওয়ের বড় বড় স্থাপনা ছিল, সেখানেই একটা মিলনায়তন থাকত। সৈয়দপুরে একটি সুপ্রাচীন রেলওয়ে ইনস্টিটিউট এবং পার্বতীপুরেও রেলওয়েকেন্দ্রিক একটি নাট্যচর্চা বহু প্রাচীন। কিন্তু এই সবকিছুরই উৎস ছিল ওই অঞ্চলের লোকায়ত জীবন। এই লোকায়ত জীবনের মধ্যেই ছিল কৃষক বিদ্রোহ। তেভাগা থেকে শুরু করে নানা ধরনের কৃষক বিদ্রোহের স্থান ছিল ওই অঞ্চল। পরেশ ওই অঞ্চলের এক যুবক, খুব শিক্ষিতও ছিল না সে। তেমন কোনো চর্চার সুযোগও পায়নি। তাহলে কী করে সে এত জনপ্রিয় হয়ে ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আবহকে উষ্ণ করতে পেরেছিল? পরেশ একটা উপলক্ষ মাত্র, কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বহু পরেশের জন্ম হয়েছিল সেই আদিকাল থেকে।

কোথাও জারিগান, সারিগান, আধ্যাত্মিক, দেহতত্ত্ব—এসব গানের চর্চা ছিল। কবিগানের মাধ্যমে দুই কবিয়ালের কী অসাধারণ বিতর্ক জমে উঠত। সেই সব লোকনাট্য বা লোক আঙ্গিকের কী পরিণতি হলো? সবটাতে একধরনের বাণিজ্যিক উপাদান এসে গেছে। এই সব লোকশিল্পী একধরনের তারকায় পরিণত হয়ে গেছে। এরা এখন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের জন্য গান গায়। এ জন্য বেশ কিছু অর্থও তারা পায় এবং একবার রেডিও-টেলিভিশনে গান করার সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। এলাকায় তার তারকা খ্যাতিও এসে যায়। একবার এক পালাগানের শিল্পীকে ঢাকায় এনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিই। সেই সঙ্গে কিছু বিজ্ঞাপনী অনুষ্ঠানেও সুযোগ পায়। তার প্রাচুর্যও বাড়তে থাকে এবং কালে কালে অপসংস্কৃতির দোসর হয়ে পড়ে। সে লোকশিল্পের উপাদানগুলো বিকৃত করে সম্পূর্ণভাবে বিনোদনের সেবাদাস হয়ে পড়ে। তার ব্যক্তিগত সংস্কৃতি এবং সমাজ সচেতনতা সে ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

আমাদের টাঙ্গাইল এলাকায় সঙ খুবই একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। এই সঙ সাধারণত করে থাকে কৃষক, শ্রমিকেরা। তারা গান এবং নাটকের মাধ্যমে সমাজের সব রকম অসংগতি, অন্যায়কে তুলে ধরে। মূল অভিনেতারা থাকত সাধারণত কৃষক, রিকশা বা ভ্যানচালকেরা। তাদের অভিনয় দেখে আমি একটি নাটক লেখার প্রেরণাও পেয়েছিলাম। লিখেছিলাম নাটক ‘সঙক্রান্তি’। নাটকটি দেশে এবং বিদেশে অনেক অভিনয়ও হয়েছে। যাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, তারাও একসময় এলাকায় তারকা হয়ে যায়। সিঙ্গেল রিড হারমোনিয়ামকে ছেড়ে তারা কি-বোর্ড ব্যবহার করতে থাকে। তবলা বা ঢোলক ছেড়ে তারা রিদম মেশিন ব্যবহারের প্রতি দ্রুতই ঝুঁকে যায়। ফলে ওই শিল্পটি শেষ হয়ে যায়।

এর মধ্য থেকে গড়ে ওঠে এক বিকৃত বোম্বাইয়া সংস্কৃতি। তারা হিন্দি গান গায়। নানা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে। একপর্যায়ে তারা সুযোগ সৃষ্টি করে ইউটিউবে। প্রচুর ভিউ পেতে থাকে। লুঙ্গি-পায়জামার বিনিময়ে তাদের পোশাকে দেখা দেয় জিনস আর টি-শার্ট। এভাবে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি অধঃপতিত হয়ে অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়। এই প্রবণতা থেকে ইউটিউবে তাদের জায়গা হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থের এবং প্রচারের প্রবণতা থেকে এই লোকশিল্পকে আমরা কীভাবে রক্ষা করব? এটি সঠিক সংস্কৃতিকর্মীদের একটি বড় সংকট এবং চ্যালেঞ্জ। তারা কি এই সংকটকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে?

না, নেয়নি। গ্রামবাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতি রক্ষার এই চর্চাকে তারা উৎসাহিত করেনি। উৎসাহিত না করার ফলে যা হয়েছে তাতে ওয়াজ মাহফিল বা ধর্মসভা বিভিন্ন স্থানে বেড়ে গেছে। একাধিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে গেছে মাদ্রাসা শিক্ষা, হিজাব-বোরকার ব্যবহার। অন্যদিকে একধরনের ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। সেই এক শ বছর আগের বেগম রোকেয়ার যে নারীমুক্তির আন্দোলন তা-ও মুখ থুবড়ে পড়েছে। নারীকে অবগুণ্ঠন মুক্তির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা এখন একেবারেই অন্তর্হিত। এই যে একটা নীরব প্রতিবিপ্লব শুরু হলো তার একটা সমাধান ছিল বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত চর্চার মধ্যে।

পরেশ এখন যুগের প্রয়োজনে অচল। কিন্তু পরেশ সচল হয় গ্রামবাংলার মেলা হলে। হায়রে দরিদ্র পরেশ! তুমি এখন আর দরিদ্র নও, যখন তোমার মেলায় ভিড় জমে আমি ছাড়াও অনেক মানুষ আসে দিনাজপুর থেকে, সারা দেশের মানুষ থাকে, তখন তুমি আর তাৎপর্যহীন হয়ে থাকো না।

জাগে মানুষ, জাগে সমাজ আর জাগে শিল্প।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালদূষণকারী কারখানা পেল পরিবেশবান্ধব পুরস্কার

ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ভারতের সংসদীয় কমিটির দীর্ঘ বৈঠক

ইস্পাহানে বাংকার বাস্টার মারেনি যুক্তরাষ্ট্র, অক্ষত ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম

বাবুই পাখির কান্না কেউ শুনল না, কেটে ফেলা হলো তালগাছটি

গোষ্ঠীস্বার্থে বহু মানুষের স্বপ্ন নষ্ট করেছে এই প্ল্যাটফর্ম: দায়িত্ব ছেড়ে উমামা ফাতেমার পোস্ট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত