Ajker Patrika

ধানের ভরা মৌসুমেও ভাতের হাঁড়িতে টান

আয়নাল হোসেন, ঢাকা ও হুমায়ূন মাসুদ, চট্টগ্রাম
আপডেট : ১৮ মে ২০২২, ০৯: ০৩
ধানের ভরা মৌসুমেও ভাতের হাঁড়িতে টান

হঠাৎ করে বেড়ে গেছে চালের দাম। আড়ত ও খুচরা বাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়ে গেছে দুই থেকে চার টাকা।

বোরো মৌসুমে যেখানে চালের দাম কমার কথা, সেখানে বেড়ে যাওয়া নিয়ে একেকজন একেক কারণ বলছেন। কেউ বলছেন, হাওরাঞ্চলে ধানের ক্ষতি এবং ঝড়-বৃষ্টিতে ধান নষ্ট হয়ে গেছে; কেউ বলছেন, বেসরকারি মিলার ও বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধান মজুত করছে, সে কারণে দাম বেড়ে গেছে। সরকারি গুদামে চাল সরবরাহকেও কেউ কেউ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাজারে চালের কোনো ঘাটতি নেই, হবেও না। মিলগুলো ধান কেনায় ব্যস্ত থাকায় সাময়িকভাবে চাল উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। দেশে ধান-চালের কোনো সংকট নেই।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার মেসার্স দ্য ভুইয়া রাইস এজেন্সি থেকে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা চাল ৩ হাজার ১৫০ টাকায় কেনেন একটি বেসরকারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক ইব্রাহিম হোসেন। তিনি বলেন, দুই সপ্তাহ আগে তিনি ৫০ কেজি চালের বস্তা ২ হাজার ৯৫০ টাকায় কিনেছিলেন। বাড়তি দামের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী তাঁকে বলেছেন, মিলে চালের দাম বেশি হওয়ায় তাঁরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এই অবস্থা শুধু ঢাকায় নয়। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের চাল ব্যবসায়ী আহসানুল করিম বলেন, নতুন মৌসুম শুরু হলেও বাজারে এখন চালের সরবরাহ কম। মিল মালিকেরা গত কয়েক দিন চাল বিক্রি বন্ধ রেখেছেন, তাই বাজারে চালের দাম বাড়ছে। পাহাড়তলী বাজারের মেসার্স জিসান রাইস এজেন্সির পরিচালক সুধাংশু সাহা বলেন, ‘গত দুই-তিন দিন শত চেষ্টা করেও কোনো চাল কিনতে পারিনি। উত্তরবঙ্গ থেকে মিল মালিকেরা বলছেন, তাঁদের কাছে কোনো চাল নেই।’

দেশের বিভিন্ন স্থানে এক মাস ধরে চলছে বোরো মৌসুমের ধান কাটা। বছরে চালের চাহিদার বড় জোগান আসে এ মৌসুমে। এ সময়ে বাজারে সরবরাহ বাড়ায় চালের দাম কমতে থাকে। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যাচ্ছে। এবার ভরা মৌসুমেই চালের দাম বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, অগ্রিম টাকা দেওয়ার পরও চাহিদা অনুযায়ী চালের জোগান পাচ্ছেন না বলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও বাদামতলী এলাকার বিভিন্ন আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল দুপুরে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৬-৫৮ টাকা। নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৩-৬৫ টাকা, যা আগে ছিল ৫৯-৬১ টাকা এবং ৪২-৪৩ টাকার বিআর-২৮ চাল গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৬-৪৭ টাকায়।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি মাঝারি মানের চাল বিক্রি হয়েছে ৪৬-৫৬ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৪-৫৫ টাকা। এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আর মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৫-৪৮ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৪-৪৬ টাকা। এ সময়ে দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

চালের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী, খাতুনগঞ্জ বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়ে জিরাশাইল রজনীগন্ধা প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ টাকা, ডায়মন্ড ৩ হাজার ৫০, নবান্ন ৩ হাজার ১০০ টাকা। অন্যদিকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে প্রতি বস্তা মিনিকেট সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়, ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে পারিজা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় এবং স্বর্ণা সিদ্ধ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকায়। অপরদিকে আতপ চালের মধ্যে মিনিকেট আতপ বস্তাপ্রতি ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়, বেতি আতপ ১০০ টাকা বেড়ে মানভেদে ২ হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়, ইরি আতপ ১০০ টাকা বেড়ে প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৫০ টাকায় ৯০০ টাকায়, কাটারি আতপ ২০০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বস্তায় ৩০০ টাকা বেড়ে প্রতি বস্তা চিনিগুঁড়া আতপ বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ১০০ টাকায়।

এদিকে চালের দাম বাড়লেও বাজারে চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে নগরের পাহাড়তলী চালের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি চালের আড়তে প্রচুর চাল মজুত আছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই দিন উত্তরবঙ্গের মিল মালিকেরা চাল বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। এভাবে এক সপ্তাহ বন্ধ রাখলে চট্টগ্রামে চালের সংকট তৈরি হবে।

ঢাকার বাবুবাজারের মেসার্স ফরিদ রাইস এজেন্সির বিক্রয় প্রতিনিধি মোশারফ হোসেন জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি চালের দাম সর্বোচ্চ চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মিলে অগ্রিম টাকা পরিশোধের পরও চালের সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন মোকাম মালিকদের সঙ্গে গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তাঁরা জানান, হাওরাঞ্চলের ধান আগাম জাতের হয়। এই ধান দিয়ে দেশে এক থেকে দেড় মাসের চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এ বছর সেখানকার ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। চিটার পরিমাণ বেড়েছে।

নওগাঁ জেলার আড়তদার নিরণ বরণ সাহা জানান, প্রতি ৬০ কেজি ধানে ৩৯-৪০ কেজি চাল হয়। কিন্তু এ বছর চিটার পরিমাণ বাড়ায় চাল পাওয়া যায় ৩৫-৩৬ কেজি। সব মিলে ঘাটতি হচ্ছে।

নীলফামারী জেলার অভিজাত রাইসের পাহাড়তলী বাজার প্রতিনিধি মুসলিম উদ্দিন বলেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এবার এখনো ধান পুরোপুরি ওঠেনি। অন্যদিকে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি দামে ধান কিনছে। তাই বাজারে ধানের দাম বেশি, এ কারণে চালের দাম বাড়ছে।

জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়বে, এমন শঙ্কা থেকে ভরা মৌসুমে বাজারে চালের দাম বাড়তে পারে। তবে উৎপাদন খরচের চেয়ে যাতে কম দামে চাল বিক্রি না হয়, সেদিকেও সরকারের খেয়াল রাখাটা খুব জরুরি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দিতেই ভারতে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত