Ajker Patrika

শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন আবেদন ১১৪

রবিউল আলম, ঢাকা
আপডেট : ২৯ মে ২০২২, ১০: ৫২
শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন আবেদন ১১৪

শিক্ষার্থী কমতে থাকা, উপাচার্যসহ শীর্ষ পদ খালি, অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে আরও পাঁচটি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি পেতে চলেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ১১৪টি।

দেশে বর্তমানে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে ১০০টিতে। বাকি ৮টি অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটির কোনো কার্যক্রম নেই। মামলাজটে বন্ধের পথে আরও চারটি। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যত শিক্ষার্থী ছিল, ২০২০ সালেও সেই একই সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে। অথচ এই সাত বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে ২৯টি। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আশানুরূপ শিক্ষার্থী না পাওয়ায় শিক্ষকদের বেতনসহ অন্য খরচ নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন প্রসঙ্গে ইউজিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম বলেন, নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনে ইউজিসির হাত নেই। ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে পাঠায়। তারপর পরিদর্শন প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে যে নীতিমালা রয়েছে, সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কি না, ইউজিসির পক্ষ থেকে শুধু সেগুলো দেখা হয়। অনুমোদন দেয় মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তবে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, অনেকের আকাঙ্ক্ষা থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। আবার বাস্তব পরিবেশ-পরিস্থিতি আমলে না নিয়েই অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। তাঁর মতে, সরকারি বরাদ্দ না থাকা এবং শিক্ষার্থীদের টাকায় চলতে হয় বলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের আগেই বিবেচনা করা উচিত লোকসান দিয়ে তাঁরা প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে পারবেন কি না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরেও বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১১৪টি নতুন আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে ইউজিসি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে এই প্রতিবেদন যাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখান থেকে সবুজ সংকেত এলে অস্থায়ী অনুমোদন পাবে এই পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রস্তাবিত এই পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয় হলো চট্টগ্রামের বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকার মতিঝিলে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ঝিনাইদহের সৃজনী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে তিস্তা ইউনিভার্সিটি এবং খাগড়াছড়ি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রথমটিতে ১৯ মে চট্টগ্রামে গিয়ে পরিদর্শন করে এসেছে ইউজিসির একটি দল। বিজিএমইএ চট্টগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিজিএমইএ ঢাকায় একই নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছে। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদন চাইছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহম্মেদ। তৃতীয়টি এম হারুন অর রশীদ নামে এক ব্যক্তি। তিস্তা ইউনিভার্সিটির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। খাগড়াছড়ি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সংশোধন করে পাঠাতে পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি।

নতুন আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যেসব স্থানে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেসব স্থানেও নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জমা পড়েছে। ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়েছেন—এমন উদ্যোক্তারাও নতুন করে ভিন্ন জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছেন। অর্ধশতাধিক উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিতে জোর তদবির ও নানা জায়গায় বিভিন্ন জনের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

নতুন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের স্ত্রী ফৌজিয়া আলম। তিনি লালন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন করেছেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ পটুয়াখালীতে সাউথ রিজিয়ন ইউনিভার্সিটি স্থাপন করতে চান। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শামসুল আলম ভূঁইয়া অ্যাপোলো ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামে চাঁদপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চেয়ে আবেদন করেছেন। আর উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াসমিন আরা ‘ইউনিভার্সিটি অব বগুড়া ট্রাস্ট’ স্থাপনের আবেদন করেন।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমছে। ওই বছর ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও ২০১৯ সালে ছিল ৩ লাখ ৪৯ হাজার ১৬০ এবং ২০২০ সালে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৮৯ শিক্ষার্থী। তবে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এখনো শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।

বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের দ্বন্দ্ব, যখন-তখন ইচ্ছেমতো বিভিন্ন ফি বাড়ানো, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির খবর শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক বার্তা দেয়। এ কারণে তাঁরা এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন। সর্বশেষ ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চার সদস্যকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়, দ্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা বাংলাদেশ এবং ইবাইস ইউনিভার্সিটি—এই চারটি প্রতিষ্ঠান মামলার কারণে বন্ধ থাকছে। এ ছাড়া বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। বর্তমানে ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ কোনো উপাচার্য নেই। আর উপ-উপাচার্য নেই ৭৬ এবং কোষাধ্যক্ষ নেই ৪৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের পূর্বে ‘নামকাওয়াস্তে’ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিপক্ষে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেন, এর জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে আইন আছে, তা ঠিক করা উচিত। অনুমোদনের আগেই সেখানে আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে কি না, উপাচার্য ও অন্য পদের জন্য যোগ্য কারা আছেন এবং ভালো শিক্ষক জোগাড় করা ইত্যাদি বিষয় দেখা উচিত। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে শুধু সনদ বিক্রি আর বাণিজ্যিকীকরণ না হয়, সেটাও খেয়াল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইউজিসিকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত