Ajker Patrika

হতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
হতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক

ভাষা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির ঐক্যের ভিত্তি। ওই ভাষা বিকশিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় অতুলনীয় সাহিত্য ও সংগীত রচিত হয়েছে; কিন্তু ভাষা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। শ্রেণির কারণে। বাঙালি তার ভাষার দ্বারাও বিভক্ত বটে। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা ছিল, ছিল আঞ্চলিকতা। সব বাঙালিকে আজও শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়নি। শিক্ষিত বাঙালি সবাই বই পড়ে না, উচ্চশিক্ষিতরা চর্চা করে ইংরেজি ভাষার।

পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যে আন্দোলন তার রূপটা ছিল গণতান্ত্রিক, ভেতরের আকাঙ্ক্ষাটা সমাজতান্ত্রিক। ওই পথে এগিয়ে নতুন রাষ্ট্র এসেছে, যে রাষ্ট্রের লক্ষ্য গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ওই লক্ষ্য থেকে রাষ্ট্র ক্রমাগত দূরে সরে গেছে এবং যাচ্ছে। এমনকি একেবারেই প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল যে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা, তা-ও প্রতিষ্ঠা পায়নি। রাষ্ট্রের এই পিছু হটার জন্য দায়ী ওই মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব আদর্শগতভাবে পুঁজিবাদী, যে জন্য অগণতান্ত্রিক ও সমাজতন্ত্রবিরোধী। এই নতুন রাষ্ট্র মধ্যবিত্তের নিজের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব ছিল। কেননা, তার দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসন, লক্ষ্য ছিল দর-কষাকষি করে সুবিধা বৃদ্ধি; সে যখন স্বাধীনতার কথা বলেছে, তখন জনগণের মুক্তির কথা ভাবেনি, ভেবেছে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির কথা। মধ্যবিত্তের একাংশ ওই স্বাধীনতা পেয়েও গেছে, তাদের স্ফীতি ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এবং প্রায় অসম্ভব পরিমাণে।

কিন্তু তারা সংস্কৃতির মিত্রপক্ষে পরিণত হয়নি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুঁজিবাদী; জনগণকে তারা বঞ্চিত রাখে এবং তোয়াজ করে সাম্রাজ্যবাদের, যে সাম্রাজ্যবাদ এখন নাম নিয়েছে বিশ্বায়নের। এই শ্রেণির সদস্যরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে অধিক প্রয়োজনীয় মনে করে। তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে, সন্তানদের রাখছে বিদেশে এবং দেশে যখন বিদ্যালয়ে পাঠায়, তখন অতি অবশ্যই ‘ভালো’ ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খোঁজে। তারা নববর্ষ বলতে থার্টিফার্স্ট নাইটকে বোঝে এবং কথোপকথনে ইংরেজিই বেশি ব্যবহার করে বাংলার তুলনায়। বাংলা ভাষা যে রাষ্ট্রভাষা হয়েও রাষ্ট্রের ও সমাজের ভাষা হচ্ছে না, তার কারণ এই বিশেষ শ্রেণি, সর্বত্র যারা নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এবং আদর্শ হিসেবে বিরাজমান। ইংরেজি শেখার ও ব্যবহার করার আগ্রহের দিক থেকে ঢাকা শহরের অবস্থা এখন ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার সঙ্গে অতুলনীয় নয়। তবে তফাত আছে, সেটা এই যে তখন সেখানে একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাও গড়ে উঠেছিল, যেটা ছিল আশার দিক। এখন সেই চেতনাটা তেমন নেই, এখনকার মধ্যবিত্ত ইতিমধ্যে সাম্রাজ্যবাদের কাছে পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে বসে রয়েছে।

আত্মসমর্পণে গৌরব নেই, আত্মসমর্পণকারী হচ্ছে ভিক্ষুক, পাত্র সে করুণার; সম্মান রয়েছে যুদ্ধে। শ্রমজীবী বাঙালি অত্যন্ত সংগ্রামশীল, ওই সংগ্রামশীলতার আরেক রকমের প্রকাশ ঘটেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। ওই নয় মাস ছিল বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময়; একই সঙ্গে সেটি ছিল সর্বাধিক গৌরবের কাল। কিন্তু ওই গৌরবটা আমরা ধরে রাখতে পারিনি; ক্রমাগত সেটা খুইয়ে শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছি একটি ভিক্ষুকের জাতিতে। রাষ্ট্র আজ দেনার দায়ে জর্জরিত এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের কঠোর নির্দেশে পরিচালিত। বেসামরিক সাহায্য সংস্থা ঋণ দিচ্ছে, বিশেষ করে গরিব মানুষকে, যে ঋণের সুদের হার কাবুলিওয়ালাদের সুদের মতো চড়া। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, এই সাহায্য সংস্থাগুলো আগের দিনের ধর্ম প্রচারকদের মতোই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের দ্বিতীয় বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। তফাত এই যে তাদের সাফল্য ধর্ম প্রচারকদের সাফল্যের তুলনায় অধিক। কেননা এ ধর্মমতটি হচ্ছে ইহজাগতিক; পরকালে মুক্তির স্বপ্ন ফেরি করে না, ইহকালেই নগদ টাকা পৌঁছে দেয় বিপন্ন মানুষের হাতে। বলা বাহুল্য, এ ধর্মমতটি হচ্ছে পুঁজিবাদ। এনজিওগুলোর প্রধান কাজ বিশ্ব পুঁজিবাদের জন্য ক্রেতা তৈরি করা। তা ক্রেতা তৈরি হচ্ছে বৈকি, গ্রামে গ্রামে এখন স্যাটেলাইট টিভি যাচ্ছে, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট চলে গেছে, হালকা পানীয় বিক্রি হচ্ছে। পুঁজিবাদের দুই বাহু—বাণিজ্য ও প্রমোদ জড়িয়ে ধরেছে বাংলাদেশকে।

আগ্রাসী বিশ্বায়ন বাঙালির জন্য দাঁড়ানোর কোনো জায়গা রাখবে না। রবীন্দ্রসংগীতকে পপসংগীত বানাতে চাইবে, সংগীতের নামে আদিম হল্লাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের মতো একটি শক্তিশালী ও অত্যন্ত সম্ভাবনার মাধ্যমকে মুক্তবাজার যে জায়গায় নিয়ে গেছে, তাতে একটি নির্মম সত্যই উদ্ঘাটিত হয়। সেটি এই যে, বাংলাদেশ এই পুঁজিবাদী বিশ্বের ভোগবাগিতার আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্ত ছায়াছবি দেখত, নাম ‘হারানো সুর’, ষাটের দশকে দেখত ‘কাঁচের দেয়াল’, এখন সে আর প্রেক্ষাগৃহে যায় না। কেননা, গেলে তাকে দেখতে হবে ‘খাইছে রে’ কিংবা ‘পারলে ঠেকা’। মধ্যবিত্ত এসব ছবি দেখে না, সেটা ঠিক, কিন্তু ঘরে বসে টেলিভিশনে যা দেখে নগ্নতা ও স্থূলতার দিক থেকে তা যে অত্যন্ত ভিন্ন মানের তা নয়; ভাষা ও দেহাকৃতি ভিন্ন, মর্মবস্তু অভিন্ন। 

পুঁজিবাদ নারীকে পণ্য হিসেবে শুধু নয়, পণ্যের বিজ্ঞাপন হিসেবেও ব্যবহার করছে। চরিত্রগতভাবে পুঁজিবাদ হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক, সে আগ্রাসী ও কর্তৃত্বপরায়ণ। মধ্যবিত্তের শ্রেণিগত চরিত্রেও পুরুষতান্ত্রিকতা রয়েছে; বিশেষ করে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের অভ্যন্তরে হিটলার-মুসোলিনি মোটেই বিরল নয়। একান্নবর্তী পরিবারগুলো পিতার একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য অভয়ারণ্য ছিল। মেয়েরা মেনে নিয়েছে, কিন্তু তাদের ওই মেনে নেওয়া আবার নীরবে প্রতিশোধ নিয়েছে ছেলেদের মাতৃবৎসল করায়। যে বাৎসল্যে মায়ের প্রতি ভালোবাসা থাকে ঠিকই, তবে ততোধিক থাকে দখলদারিতে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবন এখন অভূতপূর্ব এক অরাজকতায় বিদ্যমান। বছর বছর এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েক বছর আগের ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতায় ঘটছে একই ঘটনা। খুব বড় খবর বিশ্ব ইজতেমা, এতে ২৫ লাখ মানুষ অংশ নেয় বলে শুনেছি। এটি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অবশ্যই। কিন্তু এর সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও উপেক্ষণীয় নয়। বলা হয়েছে এটি হচ্ছে বিশ্বে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দুই ভিন্ন পক্ষের নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব-বিবাদে অতীতে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। আমাদের স্মরণে আছে, পাকিস্তানিদের কারাগার থেকে বের হয়ে ঢাকায় এসে স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনসমুদ্রে অন্যান্য ঘোষণার মধ্যে এ কথাও বলেছিলেন, বাংলাদেশ হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র। তারপরে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছে যাতে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলোর একটি; আরও পরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, কিন্তু পরের গণতান্ত্রিক সরকারগুলো তাকে ফেরত আনার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

একই সময়ে বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে বিশ্ব ইজতেমার বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল। একটি ব্যান্ড সংগীতের অনুষ্ঠান হয়েছে, রাতের বেলায়। সেখানে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থায় পশ্চিমা জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বনি এম দলটি ১৫ হাজার দর্শককে এমন উত্তেজনা সরবরাহ করেছে যে চড়া সুরের তালে তালে তরুণ-তরুণীরা একটি দৈনিকের ভাষায়, ‘শালীনতার ভেতর উচ্ছৃঙ্খলতা’ প্রদর্শন করেছে। অপর একটি দৈনিকের বিবরণ লক্ষ করার মতো, ‘নৃত্যরত সমুদ্র আছড়ে পড়ল, জলপ্রপাতের দাপট নিয়ে। এত উচ্ছ্বাস একসঙ্গে দেখার সৌভাগ্য কম হয়। ইয়াহু...ধ্বনি গানের তালে তালে বাজছে। ছুড়ে দেওয়া চুমুর মায়ায় আর্মি স্টেডিয়াম তখন নিজেই মায়াবী। প্রবীণ চোখ, নবীন হৃদয় সবাই উন্মাতাল, আবেগের জারকরসে মোহাবিষ্ট।’ বলা হচ্ছে, ‘কে আসেনি এখানে। সারা শহর নয়, এসেছে গোটা দেশের মানুষ।’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। টিকিটের দাম পাঁচ শ, তবু অভাব হয়নি দর্শকের। লক্ষ করার বিষয়, ইংরেজি দৈনিকগুলোতে এ ঘটনার বিবরণ বের হয়নি, হতে পারে এর পেছনে রয়েছে এই সত্য যে উচ্চবিত্তের জন্য এ রকম অনুষ্ঠান ততটা আকর্ষণীয় নয়, যতটা আকর্ষণীয় মধ্যবিত্তের জন্য। 

এই সময়ে পৌষমেলাও হয়েছে, ঢাকা শহরে। একটি হাজারীবাগে, অপরটি রমনায়। উপলক্ষ একই, কিন্তু দুটি মেলার মধ্যে পার্থক্য অনতিক্রম্য। হাজারীবাগ পার্কের মেলা চলেছে তিন দিন, তবে সেখানকার আয়োজন খুবই ম্রিয়মাণ, জমেনি বোঝা যাচ্ছে। কেননা, এলাকাটা মোটামুটি দরিদ্র। সেখানে আয়োজন ছিল পুতুলনাচ, ‘ভানুমতি খেলা’র এবং নাগরদোলার। রমনা পার্কের ব্যাপার অন্য। মেলা এক দিনের, তবে জমজমাট। কেননা, সেখানে গেছে সচ্ছল মধ্যবিত্ত। আয়োজন ছিল পিঠা ও খেজুর রসের, বাউলগানের ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। শিশুদের জন্য ব্যবস্থা ছিল নাটক, গান ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার।

যেই সংস্কৃতিকে আমরা বাঙালি সংস্কৃতি বলে গণ্য করতে চাইব, তার প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। তাকে হতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাগতিক, যার মধ্যে থাকবে বাঙালির সংগ্রামশীলতার প্রকাশ। সেই সঙ্গে সে হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে করা যাবে গড়ার এই কাজ? সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার একটা উপায় হচ্ছে, তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দিতেই ভারতে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত