Ajker Patrika

দারিয়ুস মেহেরজুই কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বিধান রিবেরু
দারিয়ুস মেহেরজুই কেন গুরুত্বপূর্ণ?

‘শ্রদ্ধেয় (সংস্কৃতিবিষয়ক) মন্ত্রী, শুনুন, আমি আর নিতে পারছি না। আমি লড়াই চালিয়ে যাব। আমাকে মেরে ফেলুন, অথবা যা ইচ্ছা তা-ই করুন...আমাকে ধ্বংস করে ফেলুন, কিন্তু আমি আমার অধিকার চাই।’

খুন হওয়ার ঠিক আগের বছর, ২০২২ সালে একটি ভিডিওবার্তায় নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার এই ঘোষণা দিয়েছিলেন ইরানের নব্য বাস্তববাদী ঘরানার চলচ্চিত্রের প্রতিভূ দারিয়ুস মেহেরজুই, এতে যদি প্রাণ যায় তাতেও তাঁর পরোয়া নেই। ২০১৯ সালে নির্মিত ‘লা মাইনর’ ছবিটি ইরান সরকার ছাড়পত্র দিচ্ছিল না বলে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন বর্ষীয়ান মেহেরজুই।

আর ২০২৩ সালে এসে যখন সস্ত্রীক তাঁকে ছুরিকাঘাতে নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হতে হলো, তখন এর সঙ্গে ইরান সরকারের ১৯৯৮ সালে গোপন বাহিনী দিয়ে ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করানোর ঘটনার যোগ খুঁজতে পারেন অনেকে। খুঁজছেন বলেই মেহেরজুইয়ের হত্যার পর দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ বাইদি বিষয়টি উড়িয়ে দেন। বলেন, এটার সঙ্গে আটানব্বইয়ের নভেম্বরের সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগ নেই। যদিও তদন্তকারীরা বলছেন, মতপার্থক্যের কারণেই ৮৩ বছর বয়সে খুন হতে হয়েছে মেহেরজুইকে।

১. কথা হলো, মেহেরজুইকে এত ভয় কেন? কেনইবা এই নির্মাতা এত গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে চলে যেতে হবে ইতিহাসের পত্র-পল্লবে। যদি আমরা ১৯০৫ সালের দিকে তাকাই দেখব, সেই সময় পারস্যে সাংবিধানিক বিপ্লব শুরু হয়েছে। কাজার বংশের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণ গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নে বদ্ধপরিকর। সংবিধানকে ঘিরে অনেকবার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সে সময়। এরই মধ্যে ১৯০৮ সালে দেশটিতে আবিষ্কার হয় তেলের খনি। এ ঘটনাটি মনে রাখা ভীষণ জরুরি।

অন্তত মেহেরজুইয়ের যুগান্তকারী ছবি ‘গাভ’ বা ‘গাভি’ বোঝার জন্য। সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তো, তেলের খনি আবিষ্কারের পর পারস্যের ওপর নজর পড়ে বহির্বিশ্বের। ১৯১১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন রেজা শাহ পাহলভি এবং ১৯২৩ সালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তিনি নিজেও আবার পেছনের দিকে হাঁটা শুরু করেন, অর্থাৎ ১৯২৫ সালে মজলিশ বা সংসদের ভোট নিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। ফলে দেশটিতে রাজতন্ত্রের যাত্রা পুনরায় শুরু হয়, সামান্য যাত্রাবিরতি দিয়ে। আর সাংবিধানিক বিপ্লবের স্বপ্ন তখনকার মতো সেখানেই মাটিচাপা পড়ে। রেজা শাহের স্বৈরাচারী আমলে নিষিদ্ধ করা হয় “তা’জিয়ে” অভিনয়, ১৯৩৫ সালে পারস্যের নাম পাল্টে রাখা হয় ইরান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর রেজা শাহের প্রতিপত্তি কিছুটা কমতে থাকে। অক্ষশক্তির পক্ষে থাকা ইরান চাপে পড়ে যুদ্ধকালে। ইংরেজ ও রুশ শক্তির কাছে মাথা নত করতে হয় তাদের। ১৯৪১ সালে সেখানে গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি তুদেহ্। তারা ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করে পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখে, কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বা গোপনে। এরই মধ্যে ১৯৫১ সালে মজলিশের সমর্থন নিয়ে তেলের খনি জাতীয়করণ করে ইরান সরকার। শুরু হয় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নানা তৎপরতা।

তারা তাঁকেই রাখতে চায় ক্ষমতায়, যিনি মার্কিন স্বার্থকে সংরক্ষণ করবেন। এখানে তেলের খনি একটি বড় প্রভাবক বটে। মার্কিন মদদে ষাটের দশকে শাহের নির্দেশে তৈরি হয় গোপন পুলিশ ‘সাভাক’, তারা বিরোধী স্বরকে দমন করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এই স্বৈরতন্ত্রের কালে ইরানে তুদেহ পার্টি; পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা কমরেডরা এবং আলি শরিয়তির নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ইসলামি ভাবধারার লোকজনই শাহের মূল বিরোধী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। ঠিক সেই দশকেরই শেষভাগে দারিয়ুস মেহেরজুই বানালেন ‘গাভ’ (১৯৬৯)।

২. ইরানে যখন রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র হাত ধরাধরি করে চলছে, তখন ১৯৬৯ সালে দারিয়ুস মেহেরজুইয়ের ‘গাভ’ ও মাসুদ কিমিয়াইয়ের ‘কেইসার’ ইরানের মূলধারার চলচ্চিত্রের ভিত নাড়িয়ে দেয়। এই দুই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ইরানের চলচ্চিত্রে নতুন ধরনের প্রবাহ বইতে শুরু করে। আর এ কারণেই মেহেরজুইকে বলা হয় ইরানের নয়া ঢেউয়ের অন্যতম পথিকৃৎ। ‘গাভ’ ছবিটি দিয়ে মেহেরজুই কেবল চলচ্চিত্রের পুরোনো ধারাকেই নাকচ করেননি; বরং রাষ্ট্রে যা চলছিল, বিকারগ্রস্ততা, শঙ্কা ও সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা, সেটাকেও তিনি রূপকের আকারে সরল বয়ানে হাজির করেন।

মেহেরজুই ‘গাভ’ ছবির কাহিনি নিয়েছেন ১৯৬৪ সালে গোলাম হোসেন সাইদির লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘আজাদারান-ই বায়াল’ (বায়ালের বিলাপ) থেকে। সাইদি বেশ পরিচিত বাম ঘরানার রাজনৈতিক লেখক। ইরানের গ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত সেখানকার দারিদ্র্য ও রূপকধর্মী কাহিনির কারণে বইটিও সরকারি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিল। মজার বিষয় হলো মেহেরজুই কিন্তু সংস্কৃতি ও শিল্পবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুদান নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেন, ছবি শেষ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে এবং তারা অনেকগুলো জায়গা সংশোধন করতে বলে।

অনেক দিন ছবিটি আটকেও রাখে। কিন্তু সরকারের তোয়াক্কা না করে গোপনে বাইরের চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি পাঠিয়ে দেন মেহেরজুই।৩২তম ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি যখন ফিপ্রেসি পুরস্কারের পাশাপাশি আরও কয়েকটি উৎসবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়, তখন সরকারের ওপর চাপ বাড়ে। শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবির মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এজাতুল্লাহ এনতেজামি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পাওয়ার পর শাহের সরকার বাধ্য হয় ছবিটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে। আর এ ঘটনাই ইরানের নতুন চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার পথ প্রশস্ত করে দেয়।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবোত্তর সর্বময় নেতা আয়তুল্লাহ খোমেনির ছবিটি পছন্দ হওয়ায়, ক্ষমতা বদলের পর ছবিটির ওপর আর কোনো খড়্গ নেমে আসেনি। তবে রাষ্ট্র কখনো যে শিল্পীর বন্ধু হয় না, তা জীবনের শেষনিশ্বাসেও জেনে গেছেন মেহেরজুই। আর যে শিল্পী প্রতিষ্ঠানবিরোধী তাঁকে নানাবিধ প্রতিকূলতার ভেতর পড়তে হবে, রোষের শিকার হতে হবে। মেহেরজুইয়ের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘গাভ’ দিয়েই সেটা প্রমাণিত হয়। আদতে কী ছিল সেই রাজনৈতিক বক্তব্যসমৃদ্ধ, দার্শনিক ছবিতে?

ইরানের প্রত্যন্ত এক গ্রামে হাসান নামের এক দরিদ্র কৃষক তার গরুকে ভীষণ ভালোবাসে। স্নান, আহার, বিহার সবই এই গাভিকে কেন্দ্র করে। হাসান এর যত্নআত্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ গাভিটি গর্ভবতী। গ্রামের অধিকাংশ লোকজন সে রকম কোনো কাজ করে না। কয়েকটি চরিত্র বেশ চমকপ্রদ। যেমন এক মানসিক প্রতিবন্ধী চরিত্র ও আরেকটি জানালায় বসে থাকা চরিত্র। ছবিটি শুরু হয় প্রতিবন্ধী মানুষটিকে নিয়ে গ্রামের মাস্তান ধরনের এক লোক ও ছোট ছেলেমেয়েদের নিষ্ঠুর আচরণ দিয়ে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলে লোকটি প্রতিবাদ করতে পারে না। ভাবে, এটাই বুঝি খেলা। সে-ও মেতে ওঠে সবার সঙ্গে। আর জানালায় বসে থাকা লোকটি অলস দর্শক। সে শুধু দেখেই চলে। নিষ্ক্রিয় থেকে দৃষ্টি মেলে রাখাই যেন তার কাজ।

গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে একদিন সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। হাসান একটি কাজে গ্রামের বাইরে যায়। রাতে এক অজানা কারণে গাভিটি প্রাণ হারায়। গ্রামবাসী হাসানের গাভিপ্রীতি সম্পর্কে জানে। কাজেই তারা সিদ্ধান্ত নেয় সত্য গোপন করে গাভিটিকে মাটিচাপা দিয়ে দেবে। আর হাসানকে বলবে, গাভিটি দড়ি ছিঁড়ে চলে গেছে, খুঁজে আনা হচ্ছে। হাসান যখন গ্রামে ফেরে, কেউ আর তার সঙ্গে কথা বলে না। প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটা ভেবেই সবাই শঙ্কিত। হাসানকে প্রথমে বলা হয় গরুটি পালিয়েছে। হাসানের স্বভাবতই কথাটি বিশ্বাস হয় না এবং একপর্যায়ে হাসান বিমর্ষ ও বিষণ্ন অবস্থা থেকে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

সে নিজেই গাভিতে পরিণত হয়। গোয়ালঘরে থাকে, ঘাসবিচালি খায়। এরই ফাঁকে ফাঁকে আমরা দেখি বুলোরি নামের এক গ্রাম থেকে দস্যু প্রকৃতির লোক ঘোরাফেরা করে হাসানদের গ্রামে, পশু চুরি করাই তাদের প্রধান কাজ। তো এদের ব্যাপারেও সর্বদা সজাগ থাকতে হয় গ্রামবাসীকে। হাসানও ভয় পেত, এরা তার প্রিয় গাভিটিকে চুরি করতে পারে। শঙ্কা সত্য হয়। এরা এসেছিল গরু চুরি করতে, কিন্তু গোয়ালঘরে ঢুকে দেখে গরু নেই, গরুর জায়গায় স্বয়ং মানুষ ধেনু হয়ে বসে আছে।

পরিস্থিতি যখন আরও করুণ হয়ে পড়ে, হাসানের মরো মরো অবস্থা, তখন গ্রামবাসী ঠিক করে হাসানকে অন্য গ্রামে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভেতর তিনজন গ্রামবাসী হাসানকে নিয়ে রওনা দেয়। কিন্তু হাসান কি আর মানুষ আছে? সে তো পশু! পাশবিক শক্তির সঙ্গে পেরে না উঠে গ্রামবাসী তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেতে থাকে। একজন তো তাকে প্রহার করে বসে। হাসান যেন গোঁয়ার গরু, রাখালের লাঠির বাড়ি খাচ্ছে। গরু যেমন দড়ি ছিঁড়ে দৌড় দেয়, হাসানও সে রকম একপর্যায়ে ছুটতে গিয়ে উঁচু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে।

এই চলচ্চিত্রে একাধিক স্তরে রাজনৈতিক বক্তব্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বয়ান, রয়েছে দার্শনিক চিন্তা। আমাদের এই আলোচনার শুরুতে আমরা বলেছিলাম, ইরানের তেলের খনি আবিষ্কারের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই চলচ্চিত্রে গরুটিই সেই তেলের খনির রূপক হিসেবে উপস্থিত ছিল। গরুটিকে যেকোনো মুহূর্তে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে বহিঃশত্রুরা, এই শঙ্কায় হাসান তথা গোটা গ্রামবাসী ছিল শঙ্কিত। গ্রামটি যেন ইরানের এক ছোট সংস্করণ। শঙ্কাতেই তাদের দিন কাটে, কখনো তাদের সম্পদ চুরির শঙ্কা, আবার কখনো বা সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ার শঙ্কা।

১৯৭৩ সালে শাহের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ শঙ্কাই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। শাহের শঙ্কা ছিল পশ্চিমের কাছে তেল বিক্রিতে আরবদের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে। মূলত তেলের খনি আবিষ্কারের পর থেকেই ইরানি শাসকগোষ্ঠীর শঙ্কা শুরু। হাসানের যেমন গর্ভবতী গাভি, সেই গাভির কাছ থেকে গ্রামের সবাই দুধ পেত, ঠিক সে রকম শাহের তেলের খনি, যা জনগণের ভালো-মন্দের সঙ্গে জড়িত ছিল। হাসান যেমন ভীত থাকত কখন তার পশুকে অন্যরা চুরি করে নিয়ে যায়, শাহেরও একই দশা ছিল আরবদের নিয়ে। কাজেই গরু এখানে শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ হিসেবেই উপস্থাপিত হয়নি, বলা যায় ভূরাজনৈতিক রূপক হিসেবেও গাভিটি যথার্থ রূপে ধরা দিয়েছে।

ফেরেইদুন গোভানলুর সাদাকালো সিনেমাটোগ্রাফিতে ছবির আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়; সেটি হলো গ্রামের অর্থনীতি: দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, যাদের সেই অর্থে কোনো কিছু করার নেই। পাথুরে জমিন। শুষ্ক আবহাওয়া। তার ভেতর এই দুধেল গাই আর গ্রামের মাঝখানে থাকা ছোট্ট জলাধার—এ দুটোই গ্রামবাসীকে বাঁচিয়ে রাখছিল। অপরদিকে দার্শনিক প্রতীতির দেখা মেলে: আমরা দেখি, কেমন করে একজন মানুষ নিজের অস্তিত্বকে অতিক্রম করে আরেক অস্তিত্বের ভেতর প্রবেশ করে। এক অস্তিত্ব থেকে আরেক অস্তিত্বে পরিণত হওয়ার অভিযাত্রাটিও এই চলচ্চিত্রে চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন মেহেরজুই। হাসান যেন পরজন্মে নয়, এক জনমেই দুবার জন্মলাভ করে। তার এই অপূর্ব রূপান্তরে চমকিত গ্রামবাসী হকচকিত হয়ে প্রকারান্তরে তাকে হত্যাই করে। সমাজচ্যুত ব্যক্তিকে সমাজ আর গ্রহণ করে না। কিন্তু ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় কেন? সমাজ সত্যকে মাটিচাপা দেয় বলে? নাকি প্রয়োজনের সময় তারা সহমর্মী হতে পারে না বলে?

অনেকেরই হয়তো জানা, পারস্যে ইসলাম ধর্মের আগে প্রভাবশালী ধর্ম হিসেবে বিরাজ করত জরথ্রুষ্ট্রবাদ। এই মতবাদ বা ধর্মানুসারে গরু হলো পৌরাণিক প্রথম প্রাণী, যে প্রাণী শুভ উদ্দেশ্যের প্রতীক। তো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীটি যখন মারা যায় এবং তাকে গোটা গ্রামবাসী মাটিচাপা দেয়, তখন আসলে পুরো সমাজই অশুভের দিকে যাত্রা শুরু করে। আমরা চলচ্চিত্রে সেটাই দেখি। বাইরের এলাকা থেকে গ্রামে হানা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। হাসানের পরিবর্তন ও মৃত্যু হয়। পুরো গ্রাম যেন এক শোকের ভেতর প্রবেশ করে। থমথমে পরিস্থিতি। আর ওই যে একটা লোক জানালা দিয়ে শুধু তাকিয়ে দেখে, সে যেন দর্শকের প্রতিনিধি। আমরা প্রত্যক্ষ করছি গোটা গ্রামের কর্মকাণ্ড ও ভবিতব্য। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী লোকটি কি সমাজে থাকা বুদ্ধিজীবী? যাদের সমাজ ভয় পায়, তারা সত্যকে প্রকাশ করে দিতে পারে বলে?

৩. মেহেরজুই কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেটি শুধু ‘গাভ’ নির্মাণের পর প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়। তবে মেহেরজুই আরও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘গাভে’র পর তিনি ‘আগা-ই হালু’ (মিস্টার সিম্পলটন, ১৯৬৯) বানিয়েছেন। সেখানে এক সরকারি কর্মচারীর কার্যকলাপ তিনি তুলে ধরেছেন রম্যের মাধ্যমে। এরপর তিনি নির্মাণ করেছেন রূপকধর্মী রাজনৈতিক ছবি ‘পোস্টচি’ (দি পোস্টম্যান, ১৯৭২), যাতে দেখানো হয় এক নববিবাহিত কিন্তু যৌনতায় অক্ষম এক ডাকবাহকের কাহিনি। ‘দায়েরেহ-এ মিনা’ (দি সাইকেল, ১৯৭৫) ছবিতে বস্তিতে থাকা এক ছেলের গল্প বলেন মেহেরজুই, যে ছেলেটি অসুস্থ বাবাকে শহরে আনে চিকিৎসার জন্য। তো একে একে মেহেরজুই সমগ্র জীবনে ২৪টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

তিনি ইতালির নব্য বাস্তববাদী ধারার চলচ্চিত্রের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মেহেরজুই নব্য বাস্তববাদের সারকথাটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই শুধু ইরানে নয়, গোটা দুনিয়াতেই গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নব্য বাস্তববাদ বলতে তিনি বোঝেন, নিজের আপন ভূমি ও সংস্কৃতির ভেতর তাকানো, সেখানকার বাস্তবতাকে তুলে ধরা। আর যতই আপনি নিজস্ব সংস্কৃতির গভীর থেকে বয়ান তুলে আনবেন, ততই আপনি আরও বেশি করে বৈশ্বিক হয়ে উঠবেন। দারিয়ুস মেহেরজুই সত্যিকার অর্থেই বিশ্বের সম্পদ হয়ে উঠেছিলেন, নয়তো তাঁকে নিয়ে আজ বাংলাতেও লেখালেখি হতো কি?

লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত