Ajker Patrika

অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের খাত ছেঁটে ফেলা দরকার

অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের খাত ছেঁটে ফেলা দরকার

ড. মো. আব্দুল হামিদ সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক। এমএসসি করেছেন ইউরোপিয়ান ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টে এবং পিএইচডি করেছেন বাংলাদেশের ট্যুরিজম মার্কেটিং বিষয়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ, সিন্ডিকেট এবং এসব থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

আজকের পত্রিকা: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে একাধিক মন্ত্রী সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও ক্রেতাদের সুরক্ষায় তেমন কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কী?
ড. মো. আব্দুল হামিদ: কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া বেশ কঠিন। কারণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে ধরনের সমন্বয়, নিজেদের সামর্থ্য, কর্মদক্ষতা ও তৎপরতা থাকা দরকার, অনেক ক্ষেত্রে তার ঘাটতি রয়েছে, বিশেষ করে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বণ্টন আঞ্চলিক এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নেটওয়ার্কে হয়ে থাকে। সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে কেন্দ্রীয় কোনো ব্যবস্থাপনার আওতায় পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রণ হয় না। তা ছাড়া, একেক সময় একেক পণ্যের ক্ষেত্রে কারসাজির ঘটনা ঘটে থাকে। প্রতিটি পণ্য সংগ্রহ,  মূল্য নির্ধারণ ও বণ্টনব্যবস্থা পুরোপুরি আলাদা। ফলে কারসাজি ঠেকাতে চাইলেও সহজে তা করা যায় না। আর সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা সম্বন্ধে জনমনে তো প্রশ্ন রয়েছেই।

আজকের পত্রিকা: সিন্ডিকেট অনেক বেশি শক্তিশালী বলেই কি লাগাম টানা যাচ্ছে না?
ড. হামিদ: আসলে সিন্ডিকেট চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক ও অলিখিত পন্থায়। শোনা যায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে খুচরা ব্যবসায়ীরা অজ্ঞাত সূত্র থেকে জানতে পারেন আজ ডিমের রেট কত হবে। সেই অনুযায়ী তাঁরা বিক্রি করেন। প্রকৃত ক্রয়মূল্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকে না। এমনকি টিভিতে দাম বাড়ার খবর দেখেও অনেকে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়! বিভিন্ন অভিযানের সময় এমনটা শোনা গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উচ্চমহলের নির্দেশদাতাদের (বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের) চিহ্নিত করা যায় না। তা ছাড়া, সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট একইভাবে কাজ করে না। ক্ষণে ক্ষণে এর রূপ বদলায়। ফলে প্রচলিত প্রতিষ্ঠান দিয়ে সেকেলে পদ্ধতিতে চেষ্টা করেও এমন কর্মকাণ্ডের রাশ টানা যায় না।

আজকের পত্রিকা: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিপণনব্যবস্থায় যে অনিয়ম ও অস্থিরতা রয়েছে, সেটা সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সরকার কতটা সফল?
ড. হামিদ: আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে সরবরাহ চেইন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়; বিশেষ করে সরকারি পন্থায় যেগুলো বণ্টন হয়, সেগুলো নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়। কিন্তু তা মোট চাহিদার সামান্য অংশ মাত্র। ফলে পুরো বাজারব্যবস্থায় তার প্রভাব দৃশ্যমান হয় না। আর দেশে উৎপাদিত পণ্যের মজুত, বণ্টন ও মূল্য নির্ধারণে সরকারের কিছু মেকানিজম রয়েছে। তবে সেগুলো মাঝেমধ্যে কাজ করে না। কৃষিপণ্যের বিপণনে স্থানীয় ফড়িয়া, ব্যাপারী, পাইকার ও আড়তদারদের প্রভাব অনেক বেশি থাকে এখানে।

অন্যদিকে, সরকারের অসংখ্য অধিদপ্তর ও পরিদপ্তর রয়েছে, যাদের এ বিষয়গুলো দেখভাল করার কথা। কিন্তু একমাত্র জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে সেভাবে মাঠপর্যায়ে দেখা যায় না। যেমন কয়েক দিন আগে স্যালাইনের জোগান ও দামে কারসাজি হলো। দেশে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর রয়েছে। অথচ এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কার্যক্রম আমাদের নজরে পড়েনি!

এভাবে বিএসটিআই, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর, টিসিবি, চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, কৃষি মন্ত্রণালয়—সবগুলো প্রতিষ্ঠান সোচ্চার হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা কিন্তু এতটা বেপরোয়া হতে পারত না। হ্যাঁ, স্থানীয় প্রশাসন কিছু কাজ করে। তবে তারা রুটিনওয়ার্কের বাইরে খুব একটা সময় দিতে পারে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও এই প্রক্রিয়ায় খুব একটা যুক্ত করা যায়নি। ফলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

আজকের পত্রিকা: মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না। শোনা যাচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে কম পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
ড. হামিদ: যে হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে, সেই গতিতে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ার সুযোগ নেই। তাই অনেকেই ভোগের মাত্রা কমাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে খাদ্যতালিকা থেকে অতিদরকারি আমিষ ও পুষ্টিকর উপাদান বাদ দিচ্ছে। কিছু অসৎ লোক মাঝেমধ্যেই গুজব সৃষ্টি করে মার্কেট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। সে ক্ষেত্রে তাদের হাতে রয়েছে নিজেদের জীবনযাপন প্রণালিতে পরিবর্তন এনে সমন্বয় করতে চেষ্টা করা। তাতে কিছুটা হলেও ভারসাম্য আসতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অর্থনীতির তত্ত্ব হলো কোনো পণ্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমবে। কিন্তু আমাদের দেশে ক্রেতারা প্রায়ই বাড়তি দামেও পণ্যটি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যদি না পাওয়া যায় কিংবা দাম যদি আরও বেড়ে যায়, সেই আতঙ্কে অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণে পণ্য কেনে। ভোজ্যতেল, লবণ, পেঁয়াজ, ডিমের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। ফলে সুযোগসন্ধানীদের পোয়াবারো। অন্যদিকে, সবাই ইলিশ মাছের চড়া দামের অভিযোগ করছে। কিন্তু কোনো ইলিশ মাছ ব্যবসায়ীকে মাছ বিক্রি করতে না পারায় হতাশ হয়ে বসে থাকতে দেখেছেন? আমি তো সিলেটে দেখিনি।

কথা হলো, শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণি অন্যদের অনুকরণ করতে গিয়ে দৈনন্দিন জীবনে অনেক বেশি ব্যয়ের খাত উন্মুক্ত করে ফেলেছে। যেমন বাচ্চাদের ব্যয়বহুল স্কুলে পড়ানো, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার, পরিবারে অসংখ্য দিবস উদ্‌যাপন, অপ্রয়োজনীয় পোশাক ক্রয় ইত্যাদি। ফলে সঞ্চয়প্রবণ বাঙালি জাতি কখন যে ধারকর্জ করে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তা খেয়ালই করেনি। সে ক্ষেত্রে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র দশা হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাই পরিবারে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের খাতগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলো ছেঁটে ফেলা দরকার।

আজকের পত্রিকা: অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা থাকায় তাঁদের থামানো যাচ্ছে না। কী বলবেন?
ড. হামিদ: এ ব্যাপারে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন বা গবেষণার ফলাফল রয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেরই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। কারণ নীতিনির্ধারণের সময় নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধার কথা বিবেচনায় রাখা অসম্ভব নয়। তা ছাড়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ছোট ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে অভিযান পরিচালনা বা জরিমানা করলেও অজ্ঞাত কারণে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে উদাসীন থাকে। সাম্প্রতিককালে কাজী ফার্মস ও সাগুনা ফুড লিমিটেডকে ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জরিমানা করা ছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। এসব বিবেচনা করে সাধারণ মানুষ তেমনটা ভাবতেই পারে।

আজকের পত্রিকা: ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট থেকে মুক্তির উপায় কী?
ড. হামিদ: সাধারণ মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সরকার চাইলে সিন্ডিকেট বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করতে হবে। তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় করতে হবে। মাঠে সক্রিয় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাত্র শখানেক কর্মকর্তা দিয়ে সারা দেশের কার্যক্রম তদারক করা সম্ভব নয়। লোকবলের পাশাপাশি তাদের অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে। নির্ধারিত দাম অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি পণ্য বিক্রির সময় ‘পাকা রসিদ’ দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। অভিযান পরিচালনার সময় সেটা দেখাতে ব্যর্থ হলে বড় অঙ্কের জরিমানা করতে হবে। প্রতিবার পণ্য কেনাবেচায় ক্যাশ মেমো দেওয়ার নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চললে অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করে সেগুলোকে যুগোপযোগী করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।সবচেয়ে বড় কথা, সবার আগে ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে। কয়েক দোকান যাচাই করে পণ্য কেনার অভ্যাস করতে হবে। অনিবার্য না হলে হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়া পণ্যটি সপ্তাহখানেক কেনা বন্ধ রাখতে হবে। কাঁচা মরিচের মতো পচনশীল জিনিস তারা কয়দিন মজুত রাখতে পারবে? তাই কেনার ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া দরকার।

কথা হলো, ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় কম হলেও, তাঁরা সংঘবদ্ধ। অন্যদিকে, ক্রেতারা সংখ্যায় হাজার বা লাখ হলেও তাদের মধ্যে ঐক্য নেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই নিয়তি বলে গণ্য হচ্ছে। এটা রুখতে হলে শক্তিশালী ভোক্তা-অধিকার সংগঠন গড়ে তোলা জরুরি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত