Ajker Patrika

গুলির আগের সময়টি

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
গুলির আগের সময়টি

পূর্ববঙ্গ বিধানসভার বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ৩টায়। সকালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ঘোষণা এল, তখন ‘আর্টস বিল্ডিং’-এর সামনের রাস্তায় খাকি হাফপ্যান্ট পরা সশস্ত্র পুলিশ জায়গা করে নিয়েছে। মধুর ক্যানটিনে গরম চায়ের সঙ্গে উত্তপ্ত ছাত্রছাত্রীর মুখে উত্তেজিত কথাবার্তা। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নন, মেডিকেলের ছাত্রছাত্রী, কলেজের শিক্ষার্থীরা, এমনকি স্কুলের ছেলেরাও এসে হাজির হয়েছিলেন সেখানে।

‘চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ স্লোগান যখন চলছে আর ১০ জনি মিছিল বের হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদর দরজা দিয়ে, তখন পুলিশের অবিরাম টিয়ার শেল নিক্ষেপে ঝাঁজালো হয়ে উঠেছে বাতাস।

পুলিশ ট্রাকে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের স্লোগানরত মুষ্টিবদ্ধ হাত। আমতলায় আর দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। তাই সবাই বেলতলার ডোবায় রুমাল ভিজিয়ে চোখ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন আর কেউ কেউ পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে অথবা পেছনের রেললাইন ধরে অথবা আর্টস বিল্ডিং ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে মেডিকেল হোস্টেলের দিকে যাচ্ছিলেন।

আমতলা তখন প্রায় শূন্য। আন্দোলনের প্রথম পর্বটির লড়াই হয়েছিল এখানেই। কিন্তু আমরা এখন যে সময়ের কথা বলব, সেটি দ্বিতীয় পর্বের। একুশের সকাল এবং বিকেলের লড়াইয়ের স্থান এক ছিল না। দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয় মেডিকেল ব্যারাক প্রাঙ্গণে। একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পর ছাত্রদের পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের কথা ছিল। এ পথেই পরিষদ সদস্যদের কেউ কেউ অধিবেশনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।

মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র মানিকগঞ্জের এমএলএ আওলাদ হোসেনকে ধরে নিয়ে এসে শপথ করিয়ে নেন, তিনি যেন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব তোলেন। ছাত্ররা একই উদ্দেশ্যে মন্ত্রী হাসান আলীর গাড়ি আটক করেছিলেন। পুলিশ অবশ্য অবস্থা সামাল দেওয়ায় ছাত্রদের ব্যারিকেড অতিক্রম করে তিনি চলে যেতে পেরেছিলেন।

ছাত্ররা তখন পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, আন্দোলনের এই পর্যায়ে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগই মূলত কাজ করেছিল। তখন নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের জন্য কেউ আর বসে থাকেনি। এই অসংগঠিত ছাত্র-জনতাই পুলিশের টিয়ার শেলের বিপরীতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এলাকাটি সরগরম করে রেখেছিলেন। বিশাল রকম প্রতিরোধ হচ্ছে শুনতে পেয়ে তখন ছাত্রদের সঙ্গে শুধু ঢাকার সাধারণ নাগরিকেরাই হাত মেলাননি, সরকারি কর্মচারীরাও এসে এলাকাটিকে মুখর করে রেখেছেন।

পরিষদ ভবনের চারপাশে ছিল কড়া পুলিশি প্রহরা। মেডিকেল গেট এবং মেডিকেল হোস্টেলের ভেতরেও জমায়েত বৃদ্ধি পেতে থাকে। গুলিবর্ষণের আগে পরিষদ সদস্যদের মধ্যে যাঁরা মেডিকেল হোস্টেলের ভেতরে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী। তাঁরা রিকশায় করে অধিবেশনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ছাত্রদের অনুরোধে তাঁরা মেডিকেল হোস্টেলে আসেন।

পুলিশের সঙ্গে অসম যুদ্ধ চলছিল ঠিকই, কিন্তু কেউ ভাবতেও পারেনি গুলি চলতে পারে। বেলা ৩টার পর পুলিশ বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীত দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের কোনায় সমবেত ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে একদল পুলিশ। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের জমায়েত লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে আরেক দল পুলিশ। পুলিশ মেডিকেল গেট অতিক্রম করে গিয়েও গুলি চালিয়েছিল। গুলিবর্ষণের পর ঘটনা তদন্তের জন্য যে এলিস কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তার রিপোর্ট ছিল ভুলে ভরা।পুলিশ যদি রাস্তা থেকে গুলি করত, তাহলে মেডিকেল ব্যরাকের ২০ নম্বর শেডের সামনে দাঁড়ানো আব্দুল জব্বারের শরীরে কোনোভাবেই গুলি লাগতে পারে না।

গুলি ছোড়ার আগে পুলিশ অবিরাম টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। টিয়ার শেলে তখন আর ছাত্ররা ভয় পাননি। বরং অবিস্ফোরিত শেল তুলে নিয়ে পুলিশের দিকে নিক্ষেপ করেছে। টিয়ার শেলের শব্দের সঙ্গে কখন গুলির শব্দ এসে যোগ হয়েছে, তা জানতেও পারেনি কেউ। 
পুলিশের গুলি চালনায় জন্ম হলো এক নতুন ইতিহাসের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত