Ajker Patrika

নারীর সংগ্রামের গল্প কালবেলা

মোবাশ্বেরা খানম
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১১: ৫৩
নারীর সংগ্রামের গল্প কালবেলা

চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার যোগসূত্র ছিল একটিই, আমি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত একজনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলাম জীবনের পথ একসঙ্গে চলব বলে। বাড়িতে ছবি দেখার অনুমতি ছিল না। টুটুলের সঙ্গে বিয়ের পর কিছু ছবি দেখেছি, আগে খুব অল্পই। কিন্তু আমাদের ভেতরে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়াটা ভালো ছিল। একটু-আধটু লেখালিখি করি বলে ওকে কিছু নাটকের স্ক্রিপ্ট করে দিয়েছিলাম।

‘আধিয়ার’ ছবির সাবটাইটেল আমি আর আমার এক সহকর্মী মিলে করেছিলাম। ওর সঙ্গে শুটিংয়ে যেতে পারিনি কখনো, সংসার ও নিজের পেশাগত ব্যস্ততার জন্য। ‘কালবেলা’ ছবির কাজে ও আমাকে প্রথম থেকে যুক্ত করেছিল। ওর শরীর তখন খুবই অসুস্থ ছিল, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একটা ম্যাসিভ অ্যাটাকের কারণে। ওকে একা কোথাও যেতে দিতাম না। কিন্তু ওর অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করার। শরীরটা বেশি খারাপ হওয়ায় ও যেন আরও মরিয়া হয়ে উঠেছিল। স্ক্রিপ্ট তৈরি করছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা টুটুল বোধ হয় ভেবেছিল জীবনের শেষবেলায় একাত্তরের স্মৃতিকে আরও একবার এই বিস্মৃতপ্রবণ জাতির মনে উসকে দিয়ে যাবে। তবে ও যুদ্ধের ভয়াবহতাকে প্রত্যক্ষভাবে আনতে চায়নি, সেটিকে পরোক্ষে রেখে সাধারণ মানুষের আকস্মিক বিপর্যয় ও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিকে বড় করে দেখাতে চেয়েছিল। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়ে নারীর নারীত্বই যে তাকে আরও বেশি বিপন্ন করে তোলে, সেটি ওর ভাবনায় স্থান পেয়েছিল।

সৃজনশীল কাজে কষ্ট থাকলেও এর আনন্দের বোধ অলৌকিক। সেই আনন্দটি ও চলে যাওয়ার আগে আরেকবার পেয়েছিল শুটিংয়ের সময়ে। ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর শুটিং শেষ করে যখন ফিরে এল তখন খুব দুর্বল বোধ করছিল। কিন্তু শুধু মনের জোরে কাজ করে যাচ্ছিল। ১৫ ডিসেম্বর মাঝরাতে হার্ট অ্যাটাক হলো। হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লাইফ সাপোর্টে। ১৮ তারিখে চলে গেল। আমি নিশ্চিত, হাসপাতালে যাওয়ার পথে পুরো সময়টাই ও ভাবছিল ছবিটার কী হবে। তাই ও চলে যাওয়ার পর প্রথমেই আমার মনে হয়েছে, এটা এখন আমাকেই করতে হবে, এটাই আমাকে ওর শেষ দান। আমি প্রাণ দিয়ে সেই দান গ্রহণ করেছিলাম।

কালবেলাটুটুল খুবই গোছানো স্বভাবের, ছবির স্টোরি বোর্ড তৈরি করে হাতে এঁকে দৃশ্যগুলো সাজিয়ে নিত। কোথায় কী মিউজিক হবে, সবকিছুর ছক করে কাজের একটা পরিকল্পনা করে নিত। ওর এসব রেখে যাওয়া নির্দেশনাই ছিল আমার ভরসা। আমার মেয়েরা খবর পেয়েই ছুটে এসেছিল, দুর্ভাগ্য বাবার সঙ্গে দেখা ও কথা হয়নি। ওরাই সাহস দিল, বাবার কাজ শেষ করতে হবে। ওদের নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। আমাদের ইউনিটের সবাই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল টুটুলের প্রতি তাঁদের গভীর ভালোবাসা ও দায়বোধ থেকে। বিশেষ করে সংগীত পরিচালক ফরিদ ভাই, যাঁকে করোনা কেড়ে নিয়েছে এ বছর, আর ওর দীর্ঘদিনের সহযোগী রতন কুমার বর্মন আমাকে যেভাবে সাহায্য করেছেন, তা ভোলার নয়।

পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ করতে গিয়ে অনেক নতুন শব্দ আর কাজের সঙ্গে পরিচয় হলো, সম্পাদনার ব্যাপারটি জানতাম, কিন্তু আমার কোনো ধারণা ছিল না মিউজিক, সাউন্ড, কালার করেকশন এসব বিষয়ে। দিনের পর দিন বসে থাকতাম সম্পাদকের টেবিলের পাশে। মিউজিক করার সময়েও বসে থাকতাম। কাজটি বোঝার চেষ্টা করতাম। ধীরে ধীরে এগুলোকে যতটা পারি জেনে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করে এক বছরের মধ্যে ছবিটি শেষ করলাম।
‘কালবেলা’ ছবিতে অভিনয় করেছেন তাহমিনা অথৈ, শিশির, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লুৎফর রহমান জর্জ, জুলফিকার চঞ্চল, প্রমুখ। সংগীত করেছেন ফরিদ আহমেদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত