জাহীদ রেজা নূর
বাজেটে কিসের দাম বাড়ল আর কিসের দাম কমল, তা নিয়ে টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে বিস্তর। খুব শিগগির নতুন কোনো ইস্যু এলেই বাজেট-আলোচনা স্তিমিত হয়ে আসবে। সাধারণ মানুষ এরই মধ্যে বাজার ঘুরে বুঝতে শুরু করেছেন, জীবনে কোন কোন শখ-আহ্লাদ মেটানোর স্বপ্নকে টুঁটি টিপে হত্যা করতে হবে।
নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে বাজেট শুধু একটাই পরিবর্তন নিয়ে আসে—তা হলো, আরও কৃচ্ছ্রসাধন করা। সক্রেটিস, ডায়াজেনিসরা তখন আবির্ভূত হন ত্রাণকর্তা হয়ে। কত কম জিনিস নিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায়, সে কথাগুলো তখন মনে একধরনের ভালোবাসার প্রলেপ দেয়। কিন্তু এ কথাগুলো শুধু ভূমিহীন, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ সম্পর্কেই প্রযোজ্য। কৃচ্ছ্রসাধনের কোন ধরনের ইচ্ছে পুঁজিপতি মানুষের মনে ঘটবে, এটা অতিকষ্ট-কল্পনা। তাই দারিদ্র্যকে মহিমান্বিত করা, দারিদ্র্যকে খ্রিষ্টের সম্মানপ্রাপ্তির সমান মনে করা আসলে নিজেকে প্রবঞ্চিত করার একটা তরিকা।
দুই.
আমাদের দেশে বহু দিকে উন্নতি হয়েছে। ছেঁড়া শার্ট, গেঞ্জি অথবা তালি মারা লুঙ্গি বা শাড়ি পরা কোনো মানুষ ইদানীং দেখা যায় কি না, আমার জানা নেই। কর্মসূত্রে বা ব্যক্তিগত ভ্রমণের কারণে দেশের বহু জায়গায় আমাকে যেতে হয়। পোশাকে-আশাকে সত্তরের দশকে যে দারিদ্র্য আমি দেখেছি, সেটা সম্ভবত এখন অতটা ভয়াবহরূপে নেই। ব্রয়লার মুরগি আর মাছ চাষে সাফল্য আসার পর মানুষের প্রোটিনের চাহিদা কোনো না কোনোভাবে কিছুটা হলেও পূরণ হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষক এবং খামারিরা যে যুগান্তকারী কাণ্ড ঘটিয়েছেন, একসময় তা ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে এবং মানুষ বুঝবে, মূলত সবচেয়ে গরিব মানুষই দেশের সব স্তরের মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন।
মহাসড়কে যে বিলাসবহুল বাস চলে কিংবা ধনী মানুষেরা যেভাবে চালিয়ে বেড়ান কিংবা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের মধ্যে যেভাবে আকাশপথে চলার একটা জাল বোনা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও উন্নয়নের ছোঁয়ায় অনেক কিছুই বদলে গেছে। তবে বহু আগে থেকে শোনা একটি কথার আমি পুনরাবৃত্তি করব, আমাদের দেশের ধনী-গরিবের বৈষম্য আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। যে স্বপ্ন এবং প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটি দেশ গড়ে উঠেছিল, সেই প্রতিশ্রুতি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করত। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা দিন দিন একটি সংকীর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যাপারে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছি।
রাজনীতিবিদ, আইনজীবী তথা জনগণের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কে যুক্ত মানুষের জায়গায় সংসদে যদি ব্যবসায়ীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, তাহলে তাঁরা নিজের ব্যবসার কথা ভাববেন, নাকি জনগণের কথা ভাববেন?
তাই বার্ষিক যে বাজেট নিয়ে এই সময় এত কথাবার্তা হলো, তার বাইরে আরেকটি বাজেট নিয়ে আমি আজ কথা বলতে চাই। সেই বাজেটের ঘাটতি মেটানোর মতো অবস্থায় আমরা আছি কি না, সেটাই ভেবে দেখার বিষয়।
তিন.
সংসদ আইন প্রণয়ন করে। আইন নিয়ে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁদেরই সংখ্যাধিক্য থাকার কথা সংসদে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে, আইন প্রণয়ন করা এবং সংসারের যাবতীয় তর্ক-বিতর্কে এখন তাঁরাই নেতৃত্ব দিতে পারবেন, যাঁদের হাতে রয়েছে অর্থ এবং ক্ষমতা। একটা সময় ছিল, যখন একজন সৎ-নীতিবান মানুষকে মনোনয়ন দেওয়া হতো। এখন অবস্থা পাল্টেছে। সবাই বুঝতে পারছে, নীতি বা মূল্যবোধ নিয়ে এগোতে চাইলে যে যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা মোটেই নিজের অথবা দলের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেখাপাত করতে পারবে না। জনগণকে রাখতে হবে দৌড়ের ওপর এবং এ জন্য প্রশাসনের যে যে জায়গায়, যে যে রকম ক্ষমতা প্রদর্শন করার সুযোগ হয়, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে হবে। রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসক যখন এক টেবিলে বসে ভাত খান, একে অন্যের সঙ্গে যুক্তি-পরামর্শ করেন, তখন জনগণ এবং জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হতে থাকে। দমন-পীড়ন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা প্রদর্শন করে আমাদের পেশিশক্তির প্রভুরা রাজ্য জয় করার মতো আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। গত দুই দশকে পৃথিবীব্যাপী এ ঘটনাটা ঘটেছে। আমাদের দেশ তার ব্যতিক্রম নয়। এই ভারসাম্যহীনতা কোন বাজেটের অলিগলি দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, তার উত্তর কি আমাদের জানা আছে?
চার.
করপোরেট বা সেমি-করপোরেট হাউসগুলো নিয়ে দুটো কথা লিখি।
কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার এক অনুজ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘আপনি গাধার মতো খাটলে, যাঁর জন্য খাটছেন, তাঁর চোখে আপনি গাধাই থেকে যাবেন। ফাঁকিবাজেরা ভালো থাকে, তারা হয় ডিসিশন মেকার।’
এ কথাটি যে কত বড় সত্য, আমাদের দেশের করপোরেট হাউসগুলোতে গেলে যে কেউ কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন। সেখানে সত্যি তাঁরাই ছড়ি ঘোরান, মুখের ফাঁকা বুলিই যাঁদের ভরসা। চাকরিক্ষেত্রে তাঁদের বেঁচে থাকার একটি বড় উপায় হলো, হুজুরের গুণকীর্তন করা। যে ভদ্রলোক এই সমগ্র কর্মকাণ্ডের কর্ণধার, তিনি তাঁর চারপাশে এমন একটি বলয় সৃষ্টি করেন, যে বলয়ের সবাই তাঁর গুণকীর্তনে ব্যস্ত এবং ঘটনা এত দূর পর্যন্ত গড়িয়ে যায় যে তা হীরক রাজার স্তুতিবিদ্যার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তেলবাজি করে যেতে পারলে, কর্ণধারের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলে যেকোনো ধরনের পুরস্কার তার জন্য অপেক্ষা করে। আর যদি ন্যূনতম সমালোচনা করা হয়, স্কুলে চাকরির ক্ষেত্রে যেমন অপমানের পর অপমানিত হতে হয়, এমনকি চাকরি হারানোটাও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। ‘যা বলছি তা মেনে চলো, নইলে বিপদ।’ এই যখন করপোরেট হাউসের অন্তর্নিহিত নীতি, তখন সেই বাজেটের ভারসাম্য কীভাবে আসতে পারে, তা কি কেউ খুঁজে বের করতে পারবেন?
প্রাসঙ্গিক একটা কথা এখানে বলে রাখি। কোনো করপোরেট হাউসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা খুনখারাবির কোনো খবর যখন বের হয়, তখন সেই গ্রুপে কাজ করা প্রতিটি মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই দুর্নীতিবাজ বা খুনির পক্ষ নিতে দেখা যায়। এটা যে করপোরেট আচরণের একটি স্বাভাবিক বিষয়, সেটা না বুঝলে চলবে না।
পাঁচ.
নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের কথাই বলি। ব্যবসায় সততা একসময় খুব জরুরি বিষয় বলে বিবেচিত হতো। উল্টাপাল্টাভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা আজকাল অনেক বেড়ে গেছে, তাতে মজুতদার শ্রেণির মানুষেরা তো আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেনই, খুদে ব্যবসায়ীরাও তার মজা লুটে নিচ্ছেন। যদি কোনো কারণে ৩০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে থাকেন এবং মজুতদারদের পক্ষ থেকে গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে কিংবা ভারতই আর পেঁয়াজ রপ্তানি করবে না, তাহলে সেই ৩০ টাকা দামের পেঁয়াজ সযতনে গুদামে আটকে রেখে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে তাঁর হৃদয় একটুও কাঁপবে না। তিনি মনে করবেন এটা তাঁর সৎ ব্যবসা।
এই বাজেট ঘাটতি অপূরণীয়। ‘ব্যবসা’ শব্দটার সঙ্গে এই অনুষঙ্গের যোগাযোগ বাড়ার ফলে এ বিষয়ে যে প্রচলিত মূল্যবোধ রয়েছে, সেটা আর কোনো অর্থ বহন করে না। তার পরাজয় ঘটেছে।
ছয়.
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে আমরা নোট বইয়ের কাছে সমর্পণ করেছি। উচ্চশিক্ষা বলতে যা বোঝায়, তাতেও এত বেশি খাদের সংস্থান করে রেখেছি যে সেখানে গভীরতা এবং মানবতা দুটোরই অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সত্যিকার অর্থে কোন ধরনের গবেষণা হচ্ছে এবং সেই গবেষণায় আমাদের জ্ঞানচর্চা কতটা লাভবান হচ্ছে, সেই প্রশ্ন করা হলে যে উত্তর পাওয়া যাবে, তাতে স্বস্তি মিলবে না। মূলত বিভিন্ন প্রজেক্ট পাওয়া নিয়ে যে কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে, প্রজেক্টের টাকা যেভাবে খরচ হয় এবং সেই সব অডিট রিপোর্ট ঠিকঠাক করার জন্য মরিয়া হয়ে যেসব কর্মকাণ্ড করতে হয় বলে শুনেছি, তাতে শির উঁচু করে কোনো শিক্ষক দাঁড়াতে পারবেন—এতটা ভাবা অন্যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান আছে এবং খুবই সৎ একজন শিক্ষকের কাছে শুনেছি, প্রজেক্টের টাকা কীভাবে কোথায় চুরি হয়, সেগুলো জেনেও চুপ থাকতে হয়। কারণ সব শিয়ালের এক রা। কেউ যদি প্রতিবাদ করতে যান এই অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে, তাহলে তাঁকে কোণঠাসা করে ফেলা হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রের এই বাজেট ঘাটতি কী দিয়ে পূরণ হবে? সততা ও দক্ষতা যেখানে সিস্টেমের কারণে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে, সেখানে আদর্শ শিক্ষক কিংবা তুখোড় ছাত্রের জন্য কি অপেক্ষা করতে পারি আমরা?
সাত.
ধর্মটাকে কোনো না কোনোভাবে ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে যে অন্যায় করা হয়েছে, সেই অন্যায় থেকে বেরিয়ে আসা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্তর থাকছে ফাঁকা কিন্তু বাইরেরটা ধর্মীয় ছদ্মাবরণে ঢেকে রাখার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা ছাড়া গতি নেই।
ধর্মীয় শিক্ষায় ফাঁকি থাকায় একশ্রেণির মতলববাজ ধর্মের নামে অন্য ধর্মকে খাটো করে যাচ্ছে। আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ অকপটে এই সব ধর্মব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে যাচ্ছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, এই ধর্মব্যবসা ইসলামের নামে যেমন আমাদের দেশে হচ্ছে, তেমনি বিজেপি-শাসিত ভারতেও হিন্দুত্বের নামে হচ্ছে। পারস্পরিক ঘৃণা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে মানুষের মানুষের মিলন সৃষ্টি না হয়ে বিভাজনের ধর্মীয় রাজনীতির কাছে মানবতা পর্যুদস্ত হয়েছে।
এই বাজেট ঘাটতি থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
চতুর্দিকে চক্রাকারে এই যে ঘাটতিগুলো রয়েছে, সেগুলোর একটা ফয়সালা না হলে বার্ষিক বাজেট নিয়ে কথাবার্তা বলার কোনো অর্থ থাকবে না। শুধু নিঃস্ব হতে থাকা মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের কিংবা আরও নিচে নেমে বিত্তহীনের দীর্ঘশ্বাস শুধু দেখা যাবে সেখানে। আর কিছু নয়।
বাজেটে কিসের দাম বাড়ল আর কিসের দাম কমল, তা নিয়ে টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে বিস্তর। খুব শিগগির নতুন কোনো ইস্যু এলেই বাজেট-আলোচনা স্তিমিত হয়ে আসবে। সাধারণ মানুষ এরই মধ্যে বাজার ঘুরে বুঝতে শুরু করেছেন, জীবনে কোন কোন শখ-আহ্লাদ মেটানোর স্বপ্নকে টুঁটি টিপে হত্যা করতে হবে।
নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে বাজেট শুধু একটাই পরিবর্তন নিয়ে আসে—তা হলো, আরও কৃচ্ছ্রসাধন করা। সক্রেটিস, ডায়াজেনিসরা তখন আবির্ভূত হন ত্রাণকর্তা হয়ে। কত কম জিনিস নিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায়, সে কথাগুলো তখন মনে একধরনের ভালোবাসার প্রলেপ দেয়। কিন্তু এ কথাগুলো শুধু ভূমিহীন, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ সম্পর্কেই প্রযোজ্য। কৃচ্ছ্রসাধনের কোন ধরনের ইচ্ছে পুঁজিপতি মানুষের মনে ঘটবে, এটা অতিকষ্ট-কল্পনা। তাই দারিদ্র্যকে মহিমান্বিত করা, দারিদ্র্যকে খ্রিষ্টের সম্মানপ্রাপ্তির সমান মনে করা আসলে নিজেকে প্রবঞ্চিত করার একটা তরিকা।
দুই.
আমাদের দেশে বহু দিকে উন্নতি হয়েছে। ছেঁড়া শার্ট, গেঞ্জি অথবা তালি মারা লুঙ্গি বা শাড়ি পরা কোনো মানুষ ইদানীং দেখা যায় কি না, আমার জানা নেই। কর্মসূত্রে বা ব্যক্তিগত ভ্রমণের কারণে দেশের বহু জায়গায় আমাকে যেতে হয়। পোশাকে-আশাকে সত্তরের দশকে যে দারিদ্র্য আমি দেখেছি, সেটা সম্ভবত এখন অতটা ভয়াবহরূপে নেই। ব্রয়লার মুরগি আর মাছ চাষে সাফল্য আসার পর মানুষের প্রোটিনের চাহিদা কোনো না কোনোভাবে কিছুটা হলেও পূরণ হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষক এবং খামারিরা যে যুগান্তকারী কাণ্ড ঘটিয়েছেন, একসময় তা ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে এবং মানুষ বুঝবে, মূলত সবচেয়ে গরিব মানুষই দেশের সব স্তরের মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন।
মহাসড়কে যে বিলাসবহুল বাস চলে কিংবা ধনী মানুষেরা যেভাবে চালিয়ে বেড়ান কিংবা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের মধ্যে যেভাবে আকাশপথে চলার একটা জাল বোনা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও উন্নয়নের ছোঁয়ায় অনেক কিছুই বদলে গেছে। তবে বহু আগে থেকে শোনা একটি কথার আমি পুনরাবৃত্তি করব, আমাদের দেশের ধনী-গরিবের বৈষম্য আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। যে স্বপ্ন এবং প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটি দেশ গড়ে উঠেছিল, সেই প্রতিশ্রুতি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করত। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা দিন দিন একটি সংকীর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যাপারে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছি।
রাজনীতিবিদ, আইনজীবী তথা জনগণের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কে যুক্ত মানুষের জায়গায় সংসদে যদি ব্যবসায়ীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, তাহলে তাঁরা নিজের ব্যবসার কথা ভাববেন, নাকি জনগণের কথা ভাববেন?
তাই বার্ষিক যে বাজেট নিয়ে এই সময় এত কথাবার্তা হলো, তার বাইরে আরেকটি বাজেট নিয়ে আমি আজ কথা বলতে চাই। সেই বাজেটের ঘাটতি মেটানোর মতো অবস্থায় আমরা আছি কি না, সেটাই ভেবে দেখার বিষয়।
তিন.
সংসদ আইন প্রণয়ন করে। আইন নিয়ে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁদেরই সংখ্যাধিক্য থাকার কথা সংসদে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে, আইন প্রণয়ন করা এবং সংসারের যাবতীয় তর্ক-বিতর্কে এখন তাঁরাই নেতৃত্ব দিতে পারবেন, যাঁদের হাতে রয়েছে অর্থ এবং ক্ষমতা। একটা সময় ছিল, যখন একজন সৎ-নীতিবান মানুষকে মনোনয়ন দেওয়া হতো। এখন অবস্থা পাল্টেছে। সবাই বুঝতে পারছে, নীতি বা মূল্যবোধ নিয়ে এগোতে চাইলে যে যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা মোটেই নিজের অথবা দলের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেখাপাত করতে পারবে না। জনগণকে রাখতে হবে দৌড়ের ওপর এবং এ জন্য প্রশাসনের যে যে জায়গায়, যে যে রকম ক্ষমতা প্রদর্শন করার সুযোগ হয়, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে হবে। রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসক যখন এক টেবিলে বসে ভাত খান, একে অন্যের সঙ্গে যুক্তি-পরামর্শ করেন, তখন জনগণ এবং জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হতে থাকে। দমন-পীড়ন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা প্রদর্শন করে আমাদের পেশিশক্তির প্রভুরা রাজ্য জয় করার মতো আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। গত দুই দশকে পৃথিবীব্যাপী এ ঘটনাটা ঘটেছে। আমাদের দেশ তার ব্যতিক্রম নয়। এই ভারসাম্যহীনতা কোন বাজেটের অলিগলি দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, তার উত্তর কি আমাদের জানা আছে?
চার.
করপোরেট বা সেমি-করপোরেট হাউসগুলো নিয়ে দুটো কথা লিখি।
কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার এক অনুজ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘আপনি গাধার মতো খাটলে, যাঁর জন্য খাটছেন, তাঁর চোখে আপনি গাধাই থেকে যাবেন। ফাঁকিবাজেরা ভালো থাকে, তারা হয় ডিসিশন মেকার।’
এ কথাটি যে কত বড় সত্য, আমাদের দেশের করপোরেট হাউসগুলোতে গেলে যে কেউ কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন। সেখানে সত্যি তাঁরাই ছড়ি ঘোরান, মুখের ফাঁকা বুলিই যাঁদের ভরসা। চাকরিক্ষেত্রে তাঁদের বেঁচে থাকার একটি বড় উপায় হলো, হুজুরের গুণকীর্তন করা। যে ভদ্রলোক এই সমগ্র কর্মকাণ্ডের কর্ণধার, তিনি তাঁর চারপাশে এমন একটি বলয় সৃষ্টি করেন, যে বলয়ের সবাই তাঁর গুণকীর্তনে ব্যস্ত এবং ঘটনা এত দূর পর্যন্ত গড়িয়ে যায় যে তা হীরক রাজার স্তুতিবিদ্যার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তেলবাজি করে যেতে পারলে, কর্ণধারের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলে যেকোনো ধরনের পুরস্কার তার জন্য অপেক্ষা করে। আর যদি ন্যূনতম সমালোচনা করা হয়, স্কুলে চাকরির ক্ষেত্রে যেমন অপমানের পর অপমানিত হতে হয়, এমনকি চাকরি হারানোটাও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। ‘যা বলছি তা মেনে চলো, নইলে বিপদ।’ এই যখন করপোরেট হাউসের অন্তর্নিহিত নীতি, তখন সেই বাজেটের ভারসাম্য কীভাবে আসতে পারে, তা কি কেউ খুঁজে বের করতে পারবেন?
প্রাসঙ্গিক একটা কথা এখানে বলে রাখি। কোনো করপোরেট হাউসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা খুনখারাবির কোনো খবর যখন বের হয়, তখন সেই গ্রুপে কাজ করা প্রতিটি মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই দুর্নীতিবাজ বা খুনির পক্ষ নিতে দেখা যায়। এটা যে করপোরেট আচরণের একটি স্বাভাবিক বিষয়, সেটা না বুঝলে চলবে না।
পাঁচ.
নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের কথাই বলি। ব্যবসায় সততা একসময় খুব জরুরি বিষয় বলে বিবেচিত হতো। উল্টাপাল্টাভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা আজকাল অনেক বেড়ে গেছে, তাতে মজুতদার শ্রেণির মানুষেরা তো আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেনই, খুদে ব্যবসায়ীরাও তার মজা লুটে নিচ্ছেন। যদি কোনো কারণে ৩০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে থাকেন এবং মজুতদারদের পক্ষ থেকে গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে কিংবা ভারতই আর পেঁয়াজ রপ্তানি করবে না, তাহলে সেই ৩০ টাকা দামের পেঁয়াজ সযতনে গুদামে আটকে রেখে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে তাঁর হৃদয় একটুও কাঁপবে না। তিনি মনে করবেন এটা তাঁর সৎ ব্যবসা।
এই বাজেট ঘাটতি অপূরণীয়। ‘ব্যবসা’ শব্দটার সঙ্গে এই অনুষঙ্গের যোগাযোগ বাড়ার ফলে এ বিষয়ে যে প্রচলিত মূল্যবোধ রয়েছে, সেটা আর কোনো অর্থ বহন করে না। তার পরাজয় ঘটেছে।
ছয়.
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে আমরা নোট বইয়ের কাছে সমর্পণ করেছি। উচ্চশিক্ষা বলতে যা বোঝায়, তাতেও এত বেশি খাদের সংস্থান করে রেখেছি যে সেখানে গভীরতা এবং মানবতা দুটোরই অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সত্যিকার অর্থে কোন ধরনের গবেষণা হচ্ছে এবং সেই গবেষণায় আমাদের জ্ঞানচর্চা কতটা লাভবান হচ্ছে, সেই প্রশ্ন করা হলে যে উত্তর পাওয়া যাবে, তাতে স্বস্তি মিলবে না। মূলত বিভিন্ন প্রজেক্ট পাওয়া নিয়ে যে কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে, প্রজেক্টের টাকা যেভাবে খরচ হয় এবং সেই সব অডিট রিপোর্ট ঠিকঠাক করার জন্য মরিয়া হয়ে যেসব কর্মকাণ্ড করতে হয় বলে শুনেছি, তাতে শির উঁচু করে কোনো শিক্ষক দাঁড়াতে পারবেন—এতটা ভাবা অন্যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান আছে এবং খুবই সৎ একজন শিক্ষকের কাছে শুনেছি, প্রজেক্টের টাকা কীভাবে কোথায় চুরি হয়, সেগুলো জেনেও চুপ থাকতে হয়। কারণ সব শিয়ালের এক রা। কেউ যদি প্রতিবাদ করতে যান এই অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে, তাহলে তাঁকে কোণঠাসা করে ফেলা হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রের এই বাজেট ঘাটতি কী দিয়ে পূরণ হবে? সততা ও দক্ষতা যেখানে সিস্টেমের কারণে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে, সেখানে আদর্শ শিক্ষক কিংবা তুখোড় ছাত্রের জন্য কি অপেক্ষা করতে পারি আমরা?
সাত.
ধর্মটাকে কোনো না কোনোভাবে ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে যে অন্যায় করা হয়েছে, সেই অন্যায় থেকে বেরিয়ে আসা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্তর থাকছে ফাঁকা কিন্তু বাইরেরটা ধর্মীয় ছদ্মাবরণে ঢেকে রাখার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা ছাড়া গতি নেই।
ধর্মীয় শিক্ষায় ফাঁকি থাকায় একশ্রেণির মতলববাজ ধর্মের নামে অন্য ধর্মকে খাটো করে যাচ্ছে। আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ অকপটে এই সব ধর্মব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে যাচ্ছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, এই ধর্মব্যবসা ইসলামের নামে যেমন আমাদের দেশে হচ্ছে, তেমনি বিজেপি-শাসিত ভারতেও হিন্দুত্বের নামে হচ্ছে। পারস্পরিক ঘৃণা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে মানুষের মানুষের মিলন সৃষ্টি না হয়ে বিভাজনের ধর্মীয় রাজনীতির কাছে মানবতা পর্যুদস্ত হয়েছে।
এই বাজেট ঘাটতি থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
চতুর্দিকে চক্রাকারে এই যে ঘাটতিগুলো রয়েছে, সেগুলোর একটা ফয়সালা না হলে বার্ষিক বাজেট নিয়ে কথাবার্তা বলার কোনো অর্থ থাকবে না। শুধু নিঃস্ব হতে থাকা মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের কিংবা আরও নিচে নেমে বিত্তহীনের দীর্ঘশ্বাস শুধু দেখা যাবে সেখানে। আর কিছু নয়।
আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২ ঘণ্টা আগেপাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
৩ ঘণ্টা আগেভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
৫ ঘণ্টা আগেঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫