Ajker Patrika

ওই দেখা যায় নির্বাচন

ড. মো. গোলাম রহমান
ওই দেখা যায় নির্বাচন

সংবিধান অনুযায়ী এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে কিংবা আগামী বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে নানা মহলে নানা ধরনের কথাবার্তা চালু আছে। অনেকেই ধারণা করেছেন, ঈদুল আজহার পর এই নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা-কুয়াশা সব কেটে যাবে, একটা পরিষ্কার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। জনমনে নির্বাচন নিয়ে যে কৌতূহল, তা ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকবে, নির্বাচন প্রক্রিয়াও একটি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করবে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম, গতিবিধি এবং আচার-আচরণ নিয়ে জনগণের নানা কথা ক্রমেই যেন একটা নতুন আবহ সৃষ্টি করছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার তাগিদ দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) উন্নয়ন-সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো তৎপরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে এসব সংস্থার পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানো এবং নানাবিধ সহায়তার কথাও বলা হচ্ছে। সময়ের ধারায় এসবের অনেক কিছুই আমরা ক্রমান্বয়ে দেখতে থাকব। সবকিছুর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে হারজিতের মানসিক প্রস্তুতি ও সদিচ্ছা বড় বেশি প্রয়োজন।

বিএনপি বর্তমান সরকারকে রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে কিছুদিন আগে নিজেদের এই অবস্থান তুলে ধরে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। বিএনপির পক্ষ থেকে এটিকে রুটিন বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা তো দুবার প্রতারণার শিকার হয়েছি।

তৃতীয়বার এ দেশের মানুষ আর প্রতারণার শিকার হবে না।’ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তাঁর মতে, বিদেশি কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাঁদের কাছে জানতে চান বলেই এই দেখা-সাক্ষাৎ। তাঁরা নিজেরা ধরনা দেন না—এ কথাও এর আগে আরেক সভায় তিনি বলেছিলেন।

প্রতিটি ক্ষেত্রে মির্জা ফখরুলের কথার কাউন্টার হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি আলোচনার ঝড় তুলেছে। আমাদের দেশের নাগরিকদের শাসন কিংবা অনুশাসন করার অধিকার তাদের কে দিল—এই প্রশ্ন দেশের অনেক মানুষের। এদিকে এই ভিসা নীতি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সব মানুষ একজোট হয়ে ক্ষোভ বা প্রতিবাদ জানাতে পারিনি। আমরা বলতে পারিনি যে বৃহৎ এক দেশ ভিসা নীতি দিয়ে আমাদের দেশের নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা জাগিয়ে অতি বাড়াবাড়ি করছে। যদিও আমাদের দেশের সব ভোটার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ভিসা চাইবেন না। যাঁরা আমেরিকায় যেতে চান, তাঁদের জন্য বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্ব রাখে। তা ছাড়া, ভিসা নীতির ধমকে একধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যায় রাজনীতিকদের মধ্যে। ভিসানীতির অন্যতম কথা হচ্ছে, যাঁরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তরায় সৃষ্টি করবেন, তাঁদের বেলায় এই নীতি কার্যকর হবে। সুতরাং বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য ভিসা নীতি প্রভাব ফেলবে, তা বলা যায় না। তবে এই কূটনৈতিক দলিলের অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে যে সরকারি বা প্রশাসনের লোকজন যাঁরা নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবেন, তাঁদের প্রতি একধরনের নজরদারি বা শ্যেনদৃষ্টি সারাক্ষণ তাঁদের পিছু ধাওয়া করতে থাকবে।

বিগত নির্বাচনগুলো নিয়ে কেউ কেউ মনে করেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সরকারকে খুশি করার একধরনের অভিপ্রায় বোধ করার ফলে সেসব ক্ষেত্রে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা রাখার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকেই অর্জন করতে হবে। ২০২২ সালের শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়েছে।

এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি করে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে, যেখানে অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার এবং একজন নারী লেখক।

এই নির্বাচন কমিশন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও সব রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতিকে অভিনন্দন জানাতে পারেনি। ৩২২ জনের নাম এসেছিল, তার মধ্য থেকে ১০ জনকে বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পর চূড়ান্ত নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন ধরনের সংস্থার প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে এই পদ্ধতি গ্রহণযোগ্যতা পেলেও দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো কোনো দল আইনগত বাধ্যবাধকতা আমলে নিতে চায় না, নিজেদের পছন্দের মানুষ নিয়োগপ্রাপ্ত না হলেই আপত্তি জানায়।

যা হোক, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনের কয়েকটি নির্বাচন ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছে, তাই নির্বাচন কমিশন একধরনের সন্তুষ্টি বোধ করতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু সারা দেশে ৩০০ আসনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনা করা এক বিষয় নয় বলেও মতামত সুস্পষ্ট।

এদিকে আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই, দেখব গত বছরের মার্চ থেকে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান নির্বাহী ও বার্তা সম্পাদকদের সঙ্গে কমিশনের মতবিনিময় হয়েছিল দফায় দফায়। নির্বাচন কমিশন আয়োজিত এই সংলাপ নাগরিক সমাজের দৃষ্টি কেড়েছিল। সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের মতামত, পরামর্শ ও প্রস্তাবগুলো এখন অনেকটা বিস্মৃতপ্রায়। সেই সব প্রস্তাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল নির্বাচন কমিশনের আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করা, দেশে যেকোনো নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও কারচুপিমুক্ত হচ্ছে তা দৃশ্যমান করা।

এখন দেখা যাক, এই কাজগুলো কতটুকু এগিয়েছে। সিটি করপোরেশনের যে কয়টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তাতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি।কাউন্সিলরদের মধ্যে অনেকে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং কয়েকজন জয়লাভও করেছেন। কোনো কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থীরাই বেশি অংশ নিয়েছেন। আমরা জানি, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থীদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবার অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রাণবন্ত হয়। তাতে করে নির্বাচন আনন্দঘন ও উৎসবমুখর হয়। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন ততখানি অংশগ্রহণমূলক না হলেও শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যথেষ্ট ভোটের ব্যবধানে প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভোটের ফলে দেখা যায়, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ১ লাখ ৬০ হাজার ২৯০ ভোট পেয়েছেন আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হাতপাখার প্রার্থী পেয়েছেন ১৩ হাজার ৪৮৩ ভোট। যদিও হাতপাখার প্রার্থী এক সপ্তাহ আগেই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একইভাবে সিলেটে নৌকা মার্কার প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। গত ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন আর নৌকার প্রার্থী পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৬ ভোট।

যদিও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা করা সমীচীন নয়, তার পরও অনেকে বলে থাকেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ‘স্যাম্পল ডিসপ্লে’ করার একটা সুযোগ পেল। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠার এই সুযোগের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহির বিষয়টি তারা অনুধাবন করতে পারবে বলে আমার ধারণা। এই ‘পাবলিক পারসেপশন’কে সম্মান দিয়ে নির্বাচন কমিশন একটি ভালো, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কাঠামোকে প্রশংসনীয়ভাবে কাজে লাগাতে পারবে বলে আমরা আস্থা রাখতে চাই।

লেখক: সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত