Ajker Patrika

বিদেশি মাছে কী ক্ষতি

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
বিদেশি মাছে কী ক্ষতি

কোনো একটি দেশের নদী তার মাছের জন্য পরিচিতি পায়। কানাডার দার্শনিক মাতশোনা ধলিওয়ায়ো বলেছিলেন এ কথা। বাংলাদেশের নদীগুলোর অসংখ্য দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে দেখে এটা মনে হলো। একটি তথ্যমতে, বাংলাদেশে বিদেশি মাছ আসা শুরু হয় ১৯৫২ সাল থেকে। ১৯৫২ সালে সিঙ্গাপুর থেকে সিয়ামিস গৌরামি মাছ, গোল্ডফিশ ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান, তেলাপিয়া ১৯৫৪, গুপ্পি ১৯৫৭ ও লাইলোটিকা ১৯৭৫ সালে থাইল্যান্ড, জাপান থেকে ১৯৭০ সালে গ্রাস কার্প ও সিলভার কার্প, মিরর কার্প ও ব্রিগেড কার্প নেপাল থেকে যথাক্রমে ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে, সরপুঁটি ও আফ্রিকান মাগুর থাইল্যান্ড থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৮৯ সালে নিয়ে আসা হয়। সম্ভবত পিরানহা আনা হয় আমেরিকা থেকে।

পিরানহা, আফ্রিকান মাগুর বাংলাদেশে রাক্ষুসে মাছ নামে পরিচিত। এই মাছ বন্যার মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশি জাতের অনেক মাছ খেয়ে ফেলে। এতে দেশি অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২৬০ প্রজাতির স্বাদু ও ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ এদের কারণে হুমকির মুখে।

সাকার মাছ এতটাই বিষাক্ত যে এটি পোলট্রি ফিড তৈরিতেও ব্যবহার করা যায় না। এর বিস্তার ও বিভিন্ন জায়গায় বিক্রয় মানব শরীরে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি ঘটাতে পারে। সাকার মাছের বসবাস মূলত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান অববাহিকায়। এটি সিলারিফর্মিস বর্গের লোরিকারিডাই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সাকার ও আফ্রিকান মাগুর ৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এরা খুব দ্রুত বাড়ে। ওজন ১৫-১৬ কেজি হয়ে থাকে। পিরানহা মাছ সাধারণত ৬ ইঞ্চি থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের বসবাস মূলত দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার জলাশয়ে। অনুকূল পরিবেশে এটি ৮ থেকে ১০ বছর বাঁচে। আফ্রিকান মাগুর সারা বিশ্বেই পাওয়া যায়।

সাকার মাছের কয়েক প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির সাকার মাছ প্রবেশ করেছে। একটি সাকার সাউথ ক্যাটফিশ, আরেকটি সেইলফিন ক্যাটফিশ। এই মাছের প্রজননকাল মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। একটি স্ত্রী সাকার মাছ ৫০০ থেকে ৩ হাজার ডিম পাড়ে।

এই মাছগুলো রাক্ষুসে প্রকৃতির হওয়ায় দেশীয় মাছের সঙ্গে খাবার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে ফেলে। শেওলা ও অন্যান্য জৈব উপাদান খায় বলে খাদ্যশৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু দেশীয় মাছের উৎপাদন ব্যাহত করে না, পুরো জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসের কারণ হয়।

নিষিদ্ধ সাকার মাছ এখন সারা দেশেই নদ-নদী, খাল-বিলে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই পত্রপত্রিকা, ফেসবুকে এই মাছ নিয়ে নানা খবর চোখে পড়ে। এটি দ্রুত বিস্তার পাচ্ছে। কারণ, এটি অনেক প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। এমনকি বুড়িগঙ্গায় যেখানে অক্সিজেন শূন্যের কোঠায়, সেখানেও এটি অনায়াসে বাঁচতে পারে। এটি অত্যন্ত বিষাক্ত মাছ, যেখানে ক্যাডমিয়াম পদার্থ পাওয়া গেছে। এই ক্যাডমিয়াম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি এতটাই বিষাক্ত যে এর পাখনা দ্বারা কোথাও ক্ষত হলে, সেখানে পচন ধরে। এমনকি অনেক মাছ এর খোঁচায় মারা যায়। এটি জলাশয়ের শেওলা ও প্লাঙ্কটন-জাতীয় খাবার খায়। এসব প্রাকৃতিক খাবারে ভাগ বসানোর কারণে দেশি মাছের খাদ্যসংকটে পড়তে হয়।

সাকার মাছ বাংলাদেশে আসে আশির দশকে। অনেকের মতে, এটি ব্রাজিল থেকে অ্যাকোরিয়াম মাছ হিসেবে বাংলাদেশে আসে। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, এটি অবৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছে। পুষ্টিবিদদের মতে, এর শরীরে ভারী ধাতু, যেমন কপার, জিংক, লেড বা সিসা, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এই মাছে ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৭ থেকে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এটি মানবদেহের সহনশীল মাত্রার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। এ ছাড়া জিংক যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, তা সহনশীল মাত্রার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি। বিষাক্ত এই মাছ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ছাড়াও দেখা গেছে মফস্বলের নর্দমায়ও। ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এ মাছটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সে অনুযায়ী মাছটি আমদানি, বংশবৃদ্ধি, পরিবহন, গ্রহণ, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পিরানহা এবং ২০১৪ সাল থেকে আফ্রিকান মাগুর মাছের চাষ, বংশবৃদ্ধি, বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘মৎস্য সঙ্গ নিরোধ আইন ২০১৭’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনে আফ্রিকান মাগুর ও পিরানহা মাছের রেণু, পোনা আমদানিতে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আর আইন অমান্য করলে দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

এই মাছগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পরও চাষ হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলে পিরানহা এমনকি ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, নারায়ণগঞ্জে আফ্রিকান মাগুরের চাষ হচ্ছে। উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। মৎস্যচাষি, জেলে ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। হ্যাচারিতে প্রজনন, লালন-পালন বন্ধ করতে হবে। বিমান ও স্থলবন্দরে এসব মাছের আমদানি বন্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাকার, পিরানহা, আফ্রিকান মাগুর নিষিদ্ধ করা হলেও বিদেশি অনেক মাছই আগ্রাসী প্রকৃতির, যার কারণে স্থানীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঘটছে। স্থানীয় জাতের মাছ হারিয়ে যাওয়ার আগেই এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কেননা, ক্রমেই এসব রাক্ষুসে ও আগ্রাসী প্রকৃতির মাছের কারণে জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়ছে।

এই মাছগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এগুলোর সম্পূর্ণরূপে নিধন জরুরি হয়ে পড়েছে। এসবের নিধন কার্যকর করতে হলে শুধু নিষিদ্ধ নয়, প্রয়োজনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়ে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া অ্যাকোরিয়ামের মাছ আমদানির ব্যাপারে নীতিমালা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নজরদারিও। এসব মাছের বিস্তার নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। সঙ্গে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫) ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাঁপল ইসরায়েল, তেহরানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি থেকে বিদায় নিচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত