Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে পুরো গানে হাশিম ভাইকে রাখা হয়নি

ইমন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

হাশিম মাহমুদের ‘বাজি’ গান দিয়ে এক বছরের বেশি সময় পর ফিরেছে কোক স্টুডিও বাংলা। সংগীতায়োজনের পাশাপাশি হাশিম মাহমুদের সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন ইমন চৌধুরী। এই গানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় লোকজ সংগীত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাদ্যযন্ত্রের মাধুর্য এবং লোকশিল্পকে তুলে ধরেছেন ইমন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন শিহাব আহমেদ

বাজি গানের সৃষ্টির গল্পটা জানতে চাই।

২০২৩ সাল থেকে ভাবছিলাম এমন একটা গান করব যেখানে সমতল, সমুদ্র, পাহাড়, নদীপারের মানুষকে একত্র করা যায়। যেটা দেখে সবাই বুঝতে পারবে এটা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। তখন আমার মনে হলো হাশিম ভাইয়ের বাজি গানটি পারফেক্ট। এখানে পুরো ব্যাপারটাই আছে, যেখানে সবাইকে একসঙ্গে দেখানো যাবে।

সবাইকে একসঙ্গে করা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

চ্যালেঞ্জ তো ছিলই। তবে, ভালোবেসে করলে প্রকৃতিও সহায়তা করে। মারমা ভাষায় যিনি গেয়েছেন ম্রাকোইচিং মারমা। তাঁকে যুক্ত করার পেছনেও একটা গল্প আছে। আমরা চিন্তা করছিলাম গানের শুরুটা কীভাবে হবে। প্রথমে ভাবলাম বম জনগোষ্ঠীর ব্যাম্বো ড্যান্স দিয়ে বাঁশের তালে তালে শুরু করব। আবার এমন কিছুও চাইছিলাম যেটা আমাদের দেশে আগে হয়নি, ‘কথা কইয়ো না’তে যেমন আমরা ব্যবহার করেছিলাম পাতার বাঁশি। আমরা খুঁজে পেলাম আমাদের নানিকে। তাঁর খবর দিয়েছিলেন অর্ণব ভাই। একই দিনে বংশীবাদক কিয়ো উ প্রু মারমা ওনার কথা বললেন। আমি দেখলাম তাঁর গানের ভাবার্থ আমাদের গানের সঙ্গে মিলে যায়। এটাকে পাহাড়ের পুঁথি বলা হয়। এখন এটা একদমই হারিয়ে গেছে। ওনার কণ্ঠটাও ম্যাজিক্যাল মনে হলো। মনস্থির করলাম যেভাবেই হোক তাঁকে আমাদের লাগবে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উনিও রাজি হলেন।

তিনি কি ঢাকায় থাকেন?

তিনি আগে কখনোই ঢাকায় আসেননি। বান্দরবানে যেখানে ওনার বাড়ি সেখান থেকে বান্দরবান শহরে আসতেও প্রায় এক দিন লাগে। ওনার বয়স ৬০-এর বেশি। তাঁকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন তাঁর মেয়ে। তিনিও প্রথম ঢাকায় এলেন। মণিপুরি ঢোলের পুং গ্রুপটার খবর দিয়েছে আমার স্ত্রী। ওরা যে বাংলাদেশের, এটা আমিও বুঝি নাই। আমার স্ত্রী আমাকে ওদের একটা শোয়ের ভিডিও দেখায়। ঢোল বাজিয়ে ড্যান্স করে, দারুণ লাগে। ভেবেছিলাম ওরা ভারত থেকে এসেছে। যখন জানলাম তারা বাংলাদেশের, সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁরাও বাজি গানের অংশ হতে পারে। আর ধুয়ার গানের দল ঢাকা বিভাগ বা আশপাশের জেলার। তাদের কথা জেনেছি আব্বুর কাছ থেকে। ২০২৩ সালে উনি আমাকে একটি ভিডিও পাঠিয়ে বলেন, দেখো তো কী সুন্দর! এরপর ধুয়া গান নিয়ে জানার চেষ্টা করি। প্রায় ১০০ বছর আগে থেকে চলে আসছে এই ঘরানা। কিন্তু এক্সপ্লোর করা হয়নি সেভাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বাজিতে আমরা ধুয়া গান ব্যবহার করব।

জালাল উদ্দিন খাঁর লেখা গান থেকে সুর করে ধুয়া গানটি তৈরি হয়েছে। এই পরিকল্পনা কে করেছিলেন?

বাজি হলো কথা কইয়ো না গানের সিকুয়েল বা জবাব। কথা কইয়ো নার একটা অংশ নিয়েছিলাম মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে। সেখানে মেয়েদের একটি দল গানটি করেছে। আর এখানে ছেলেদের একটি দল সেই কথার জবাব দিয়েছে। গানের কথা নিয়ে যখন চিন্তা করছিলাম, তখন জালাল উদ্দিন খাঁর লেখা কথাগুলো মনে ধরল। জালাল উদ্দিন খাঁর একটা বই আমার কাছে আছে। সেখান থেকে দুটি গানের পঙ্‌ক্তি মিলিয়ে ধুয়া গানের ঘরানায় সাজিয়েছি। অবশ্যই জালাল উদ্দিন খাঁর পরিবারের অনুমতি নিয়েই করা হয়েছে।

কোক স্টুডিওর দ্বিতীয় সিজনে এসেছিল কথা কইয়ো না, এবার বাজি। দুটি গানেই বেছে নিয়েছেন হাশিম মাহমুদকে। এর কারণ কী?

কথা কইয়ো না গানের সময়েই পরিকল্পনা ছিল সিকুয়েল করার। এর জার্নিটা পরিপূর্ণ করার। কথা কইয়ো না গানের জবাবে বাজি ধরার মধ্য দিয়ে শেষ হলো এই জার্নি।

হাশিম মাহমুদের লেখা আগের দুটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এরফান মৃধা শিবলু। এবার হাশিম মাহমুদকে নিয়েই বাজি গাইলেন আপনি। এই পরিকল্পনা কীভাবে হয়েছিল?

হাশিম ভাইয়ের ‘সাদা সাদা কালা কালা’ ও ‘কথা কইয়ো না’ গান দুটি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। খুব করে চাইছিলাম উনি আমাদের সঙ্গে সেটে থাকুন। কথা কইয়ো নার সময়েই চেয়েছিলাম ওনাকে দিয়ে গাওয়াতে। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় সম্ভব হয়নি। এবার তাই মিস করতে চাইনি। কোনো একটা অংশে তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন—এটা আগে থেকেই পরিকল্পনা হচ্ছিল। যেন তাঁকে সম্মান জানাতে পারি, এমন একটা প্ল্যাটফর্মের আর্কাইভে যেন তিনি থাকেন।

আগেই হাশিম মাহমুদের গলায় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া গান বাজি। এমন পরিচিত গান নিয়ে ফিউশন করলে আগের গানের সঙ্গে তুলনা হয়। বিষয়টি মাথায় ছিল কি?

তুলনা হওয়াই স্বাভাবিক। একটা গানের মূল কারিগরের ভাইব তো কখনোই ফুলফিল করা সম্ভব না। কিন্তু এটাও ঠিক কোক স্টুডিও পুরোনো ও নতুনের মিশ্রণ। আমরা চেষ্টা করেছি নতুন প্রজন্মের মানুষেরাও যখন গানটি শুনবে, তারা যেন নতুন ভাইব পায়। আবার পুরোনো আবেগটাও যেন থাকে। আমি সব সময় ফিল করি ওল্ড ইজ গোল্ড। হাশিম ভাইয়ের আগের যে ভিডিওটির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, সেই গানের মুগ্ধতা থেকেই তো গানটি করা।

অনেকে বলছেন পুরো গানটি হাশিম মাহমুদকে দিয়ে গাওয়ালে ভালো হতো। দুজনে গাওয়ার বিষয়টা কি আগে থেকে পরিকল্পনা ছিল, নাকি অন্য কোনো সমস্যা ছিল?

একটা পুরো গান গাওয়ার মতো অবস্থা তাঁর নেই। এ রকম একটা গানে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। একটা গল্প থাকে, পরিচালকের পরিকল্পনা থাকে, ক্লায়েন্টের পরিকল্পনা থাকে। সব মিলিয়ে একটা জার্নি থাকে। শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করেই পুরো গানে হাশিম ভাইকে রাখা হয়নি। এত বড় প্রোডাকশনে আমার একার চাওয়াতে কিছু হয় না। এটা একটা টিমওয়ার্ক। এখানে যে আমি গাইব সেটাও আমার চাওয়াতে হয়নি। নিজে গাওয়ার চেয়ে আমি সব সময় অন্যদের গাওয়াতে পছন্দ করি। সবার ইচ্ছা ছিল নতুন প্রজন্মের কাছে ফ্রেশ ভাইবে গানটি উপস্থাপন করার। আবার আমরা চাইছিলাম হাশিম ভাইকে সম্মানিত করতে। সেই সঙ্গে এটাও বিবেচনায় ছিল উনি অসুস্থ, আবার প্রোডাকশনেও যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। সব মিলিয়ে সবার সিদ্ধান্তে বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়েছে। আমরা পাহাড়, সমুদ্র ও সমতলের মানুষদের একত্র করতে চেয়েছি, হাশিম ভাইকে সম্মান দিতে চেয়েছি, সেটা পেরেছি।

কেউ কেউ বলছেন পাহাড়, সমুদ্র ও সমতলের এই মিশ্রণে আসল গানটির আবেদন খানিকটা হারিয়েছে। এই বিষয়ে আপনার কী মন্তব্য?

বাজি গানটি তো হাশিম মাহমুদের কণ্ঠে স্টুডিওতে কখনো রেকর্ডই হয়নি। এবার হলো। আগের ভিডিওটিতে হাশিম ভাই যে স্থানে এবং যে মুডে ছিলেন সেই ভাইবে গেয়েছেন। ওই গানের সঙ্গে এই গান কম্পেয়ার করার কোনো কারণই নেই।

হাশিম মাহমুদের গান নিয়ে আর কী পরিকল্পনা আছে?

আমরা তো হাশিম ভাইয়ের ভক্ত। তাঁর গানগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আরও কাজ করতে চাই। তবে ওনাকে অসম্মান করে নয়, যেভাবে এখন পর্যন্ত সবার সামনে উপস্থাপন করেছি, এভাবে করতে পারলে করব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত