Ajker Patrika

‘চন্দ্রাবতী কথা’ নিয়ে কিছু কথা

জুবায়ের ইবনে কামাল
‘চন্দ্রাবতী কথা’ নিয়ে কিছু কথা

‘চন্দ্রাবতী কথা’ এমন এক গল্প যা আপনাকে নিয়ে যাবে ৪০০ বছর আগের দুনিয়ায়। প্রথমবার দেখার সময় পড়াশোনার অভাবে কিছু বিষয় দুর্বোধ্য লেগেছিল। তবে ৪০০ বছর আগের ময়মনসিংহ গীতিকা ও চন্দ্রাবতীর জীবন সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকলে ছবিটি বেশ উপভোগ্য। ‘চন্দ্রাবতী কথা’র নান্দনিকতা বুঝতে হলে আমাদের গল্পটা জানা প্রয়োজন।

সময়টা ছিল আনুমানিক ১৫৫০ সাল। জন্ম নিলেন চন্দ্রাবতী। তাঁর বাবা দ্বিজ বংশীদাস ছিলেন ওই সময়ের অন্যতম মনসামঙ্গলের কবি। কথিত আছে, তাঁর বাবার গান শুনে দুর্ধর্ষ ডাকাত কেনারাম তাঁর শিষ্যে পরিণত হয়েছিল। দ্বিজ বংশী দাস যখন মনসা দেবীর গান গাইতেন, তখন নিরব হয়ে যেত চারপাশ। বাবার কাছেই এসব গান শিখতেন চন্দ্রাবতী। সহপাঠী হিসেবে থাকতেন আরেক কিশোর— জয়ানন্দ। দুজনের মনে তখন থেকেই ছিল প্রেমের উচ্ছলতা।

বড় হওয়ার পর সবার সম্মতিতে জয়ানন্দের সঙ্গে চন্দ্রার বিয়ে ঠিক হয়। যেদিন সন্ধ্যায় বিয়ে, সেদিনই বাস্তবতা মোড় নেয় অন্যদিকে। যা অসংখ্য পালাকবির রচনায় উঠে এসেছে নানাভাবে।

ষোড়শ শতকের ময়মনসিংহ গীতিকার সমকালীন পটে নির্মিত হয়েছে ছবিটিজয়ানন্দ হুট করেই অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেন। অথচ সেই সন্ধ্যায় বিয়ের পিঁড়িতে জয়ানন্দের অপেক্ষায় চন্দ্রা।

চন্দ্রাবতী যখন জানতে পারেন, জয়ানন্দ অন্য ধর্মের এক মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছেন— ভীষণ মর্মাহত হন। বাবাকে জানান, তিনি আর বিয়ে করবেন না। শিব পূজার মাধ্যমে যোগ দেবেন আধ্যাত্মিক যাপনে। নতুন করে রচনা করবেন রামায়ণ।

তবে এটা তখনও কেউ ধারণা করতে পারেনি, চন্দ্রাবতী তাঁর লেখা রামায়ণে নিয়ে আসবেন নতুন এক মাত্রা। যা টিকে পরবর্তী কয়েক শ বছর।

গল্পের এই অংশে প্রবেশ করতে নির্মাতা তিনটি ভিন্ন ন্যারাশনে গল্প বলেছেন। প্রথমত খোকন বয়াতি, হামিদ বয়াতি ও লাল মাহমুদের কণ্ঠে নয়াচাঁদ ঘোষের লেখা ‘চন্দ্রাবতীর পালা’ গানের বিভিন্ন অংশ গাওয়ার মাধ্যমে চন্দ্রাবতীর জীবনের কিছু মূহুর্তের উত্থান-পতন সম্পর্কে দর্শক অবহিত হতে থাকেন।

অন্যদিকে গানের সুত্র ধরে আমরা একে একে দেখি কেন্দ্রীয় চরিত্রে দিলরুবা দোয়েলের অভিনয়ে চন্দ্রাবতীর যাত্রা। জয়ানন্দের চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণ কিংবা চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজ বংশীদাসের চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় কিংবা সোনাই চরিত্রে কাজী নওশাবা আহমেদের দক্ষ অভিনয় আমাদেরকে ভিন্নভাবে সেই সময়টাকে দেখিয়ে দেয়।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী কবি চন্দ্রাবতীকে উৎসর্গ করে ছবিটি বানিয়েছেন এন রাশেদ চৌধুরীএই দুটো আলাদা মাধ্যমের বাইরেও কিছু স্থিরচিত্রের মাধ্যমে সিম্বোলিক উপায়ে বিভিন্ন সময়ে গল্প বলতে দেখা যায়। যা সিনেম্যাটিক ভাষায় বেশ শক্তিশালী। যদিও কিছু স্থানে ব্যর্থ জাম্প কাটের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।

কাজী চরিত্রে আরমান পারভেজ মুরাদ দারুণ অভিনয় করেছেন। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা দিলরুবা দোয়েল দেখিয়েছেন দারুণ পারফরমেন্স। প্রদীপের আলোয় তাঁর চোখের চাহনি আপনাকে নিয়ে যাবে চার শ বছর আগের এক ট্রাজেডিতে।

চন্দ্রাবতী যে রামায়ণ লেখা শুরু করেছিলেন, তাতে মুখ্য হয়ে উঠেছিল সীতা। নীরব এক মন্দিরে শিব পূজা আর রামায়ণ লেখায় মগ্ন চন্দ্রাবতীর সঙ্গে যখন মাঝে মাঝেই দেখা করতে আসেন তার বাবা, চন্দ্রা তখন বাবাকে বলে— সীতা মার সঙ্গে কি খুব খারাপ ব্যবহার হয়নি? কেন আমরা সীতার দুঃখ অনুভব করতে পারিনি? বাস্তবেই ১৬০০ সালে যখন মারা গেলেন চন্দ্রাবতী, তখনও শেষ হয়নি রামায়ণ। তবে সেই অসমাপ্ত রামায়ণ জুড়ে ছিল শুধু সীতা ট্রাজেডির বয়ান।

২০১৩-১৪ সালে সরকারি অনুদান পাওয়া ‘চন্দ্রবতী কথা’ মুক্তি পেয়েছে ২০২১ সালে। নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরীর তুলে এনেছেন এই অঞ্চলের শেকড়ের গল্প। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির শত বছর ধরে চলে আসা বেদনা ও বাস্তবিক গল্পের ছোঁয়া।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত