Ajker Patrika

শিশু হত্যায় বিক্ষুব্ধ সেই ৪ গ্রাম মামলার ভয়ে পুরুষহীন

রানীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি
শিশু হত্যায় বিক্ষুব্ধ সেই ৪ গ্রাম মামলার ভয়ে পুরুষহীন

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় পুলিশ সদস্যকে জখম ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় অজ্ঞাত ৮০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফলে মোটরসাইকেল বা বড় গাড়ির শব্দ শুনলেই পুলিশের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে আশপাশের চার গ্রামের পুরুষেরা। খেয়ে না খেয়ে নানা দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন এসব গ্রামের শিশুসহ নারীরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বাচোর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পরাজিত প্রার্থীর সমর্থক ও পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে এক শিশু নিহত হয়েছে। এর প্রতিবাদে সাধারণ জনগণ ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে এবং একপর্যায়ে দুজন পুলিশ সদস্যকে স্থানীয়রা জখম ও তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনার পর নির্বাচনের প্রিসাইডিং অফিসার খতিবর রহমান এবং রানীশংকৈল থানার পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আহাদুজ্জামান ও বিলাস পৃথক তিনটি মামলায় অজ্ঞাত ৮০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এর ফলে ৩ নম্বর ওয়ার্ড ও আশপাশের ভাংবাড়ী, ময়মনসিংহ পাড়া ও বেল পাড়াসহ চারটি পাড়ার পুরুষেরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছেন।  

এ বিষয়ে জানতে পরাজিত প্রার্থী খালেদুর রহমানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে, তিনি নির্বাচন সহিংসতার জন্য পুলিশ ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার খাদেমুল ইসলামকে দোষারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘ঘুষের বিনিময়ে জনসমর্থনহীন ইউপি সদস্য বাবুল ইসলামকে নির্বাচিত করেছেন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার। ভোট সেন্টারে তিনি ফলাফল ঘোষণা না করে, ওই ভোটকেন্দ্র স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিনকে দিয়ে ফলাফল ঘোষণা করান। এতে সাধারণ জনগণ ক্ষেপে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধে, একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে একটি শিশুর মৃত্যু হয়।’

আজ বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের রাস্তাগুলো পুরুষ শূন্য, বাজারের দোকানপাটগুলোও বন্ধ। বিকেলে আসরের নামাজের সময় মসজিদে আজান শোনা যায়নি। কোনো মুসল্লিকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেও দেখা যায়নি।

ঠাকুরগাঁও ১,৩—   গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে বাচোর ইউনিয়নের চারটি গ্রাম। এদিকে বাড়িতে পুরুষ না থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস বাজার থেকে কিনতে পারছেন না বলে বিপাকে পড়েছেন নারীরা। এ ব্যাপারে সুমি নামে এক নারী জানান, তাঁর ছোট একটি শিশু রয়েছে। তাঁকে প্রতিদিন দুধ কিনে খাওয়াতে হয় কিন্তু শিশুটির বাবা পুলিশের ভয়ে বাড়িতে থাকতে না পারায় তিনি শিশুকে দুধ কিনে দিতে পারছেন না। 

বেল পাড়ার মধ্যবয়সী এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চেয়ারম্যান-মেম্বার যারা হওয়ার তারা হবি, হামাগো ভোট দেওয়াতে কি অপরাধ? কি এক্কান ভোট হয়েছে তাতে ওমরা ওমরাই মিলে পুলিশের সাতে গোলমাল করিল আর এলা হামার মরণ হচে। বাড়িত মোর তিনটা ছইল। পুলিশের ভয়ে বাড়িত আসির না পারে। মোর ছইল লাতো কাজ করি ভাত খায়। ওমরা কোনো গন্ডগোল করে নি। তারপরও ওমাকো নাকি পুলিশ ধরিবে এই ভয়ে ওমরাও পালি বেড়াছে।’ 

সংঘর্ষের ঘটনার পরদিন পুরুষেরা বাড়িতে থাকলে মামলার পর থেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি থাকছেন না তারা। ফলে বাজার-সদাই না করতে পারায় ছেলে-মেয়েসহ না খেয়ে দিনযাপন করছেন স্থানীয়রা। এমনকি ভাংবাড়ী গ্রামের মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন না থাকার ফলে মসজিদের আজান-নামাজ কিছুই হচ্ছে না বলে জানান সাহিদা নামে এক নারী। 

এদিকে পরাজিত প্রার্থী খালেদুর রহমানের বক্তব্যকে অস্বীকার করে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা খাদেমুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভোট ও ফলাফল ঘোষণা যথা নিয়মে হয়েছে। নির্বাচনের দিন যতটুকু সহিংসতা হয়েছে সে ঘটনার আলোকেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।’ 

গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে বাচোর ইউনিয়নের চারটি গ্রাম।বিজয়ী ইউপি সদস্য বাবুল ইসলাম বলেন, ‘অবশ্যই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে আমি জয়ী হয়েছি। পরাজিত প্রার্থীরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই সব হামলা করেছেন। এসবের জন্য তারাই দায়ী।’

এদিকে সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তের জন্য তিন সদস্যের তদন্ত দল গঠন করা হয়। গত সোমবার তদন্ত দল ও ঘটনার সময় থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মিলে ভোটকেন্দ্র ও শিশু নিহতের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে দুপুর ২টায় নিহত শিশু সুরাইয়ার মা মিনারা বেগম ও বাবা বাদশাহ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্ত কমিটি। প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্ত কমিটির প্রধান ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট রামকৃষ্ণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থলে আসা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা কি ঘটেছে তা তুলে ধরা হবে এবং ৭ কর্মদিবসের মধ্যে এর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’ 

এই বিষয়ে বাচোর ইউনিয়ন পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান জিতেন্দ্র নাথ বলেন, ‘শিশু হত্যার বিষয়টি দুঃখজনক। পুলিশের মামলায় কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয় সে জন্য প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে।’ 

এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান শাহারিয়ার আজম মুন্নার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘নিরপরাধ কেউ আটক হবে না। হলে এর প্রতিবাদ করা হবে। মামলা হলেও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ যেন কাউকে গ্রেপ্তার না করে সে জন্য ঊর্ধ্বতন প্রশাসনকে অনুরোধ করা হয়েছে।’ 

এ প্রসঙ্গে রানীশংকৈল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাহিদ ইকবাল বলেন, ‘মামলার আতঙ্কে গ্রাম পুরুষশূন্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিরপরাধ কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না, আমরা এটির নিশ্চয়তা দিচ্ছি। তদন্ত সাপেক্ষেই উপযুক্ত প্রমাণ নিয়েই দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে না নেওয়ার প্রস্তাব র‍্যাব ডিজির

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত