Ajker Patrika

রাবিতে শিক্ষার্থীকে ‘নির্যাতনের’ নেপথ্যে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২২, ০০: ০৮
রাবিতে শিক্ষার্থীকে ‘নির্যাতনের’ নেপথ্যে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আবাসিক হলকক্ষে ডেকে মারধর ও নির্যাতনের শিকার এক ছাত্র ভয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে একটি অভিযোগ পাঠিয়েছেন তিনি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তিনি। 

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ঘটনার নেপথ্যে আছে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব। তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী কাজ করতেন একটি আউটসোর্সিং আইটি প্রতিষ্ঠানে। তাঁরা তিনজনই একই সময় চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর নিজেরা একটি আইটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। আগের প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগ করছে, এই তিনজন তথ্য চুরি করে তাঁদের ক্লায়েন্ট ভাগিয়ে নিয়েছে। এতে তাদের এক বছরেই ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। 

এই শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন পড়াশোনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর নাম মো. আল-আমিন। গত ১৭ আগস্ট আল-আমিন পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে আসেন। তখন আগের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তথ্য চুরির অভিযোগ তুলে তাঁকে ধরেন। পরে আল-আমিন নিজের বাড়ি শরীয়তপুরে চলে যান। গতকাল বৃহস্পতিবার কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আল-আমিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠান। 

লিখিত অভিযোগে আল-আমিনের অভিযোগ, গত ১৭ আগস্ট তাঁকে হলে আটকে রেখে মারধর করা হয়েছে। এখন ভয়ে তিনি ক্যাম্পাসে আসছেন না। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপরই ঘটনার পেছনে দুই আইটি প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব সামনে এসেছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাবির তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আল-আমিন এখন ‘এআরপি আইটি সলিউশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠানটির অফিস মাদারীপুরে। এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রাত্রী জমাদ্দার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রসাদ সাহা। তিনজনই রাজশাহীর নওহাটার ‘অ্যামাজোপিফাই লিমিটেড’ নামের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানটি স্টোর ম্যানেজমেন্টের কাজ করে। এ প্রতিষ্ঠানে রাত্রী ছিলেন সিনিয়র মার্কেটিং অফিসার, প্রসাদ স্টোর ম্যানেজার এবং আল-আমিন ছিলেন মার্কেটিং ম্যানেজার। গত বছরের নভেম্বরে তাঁরা চাকরি ছেড়ে দেন। 

আল-আমিন বলেন, অ্যামাজোপিফাইয়ের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁরা আলাদা প্রতিষ্ঠান করেন। এরপর অ্যামাজোপিফাইয়ের কিছু ক্লায়েন্ট তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সেবা নিচ্ছে। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৭ আগস্ট তাঁকে রাবির রবীন্দ্রভবন থেকে বঙ্গবন্ধু হলের ৩৩১ নম্বর কক্ষে নিয়ে গিয়ে তাঁকে নির্যাতন করেছেন অ্যামাজোপিফাইয়ের চেয়ারম্যান ফয়সাল আহমেদ ওরফে শশী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুমিনুর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকি উদ্দিন। এ তিনজনই রাবির সাবেক শিক্ষার্থী। হলে তাঁকে মারধরের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও মতিহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহাও ছিলেন। সেখানে মারধর, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা এবং ডেবিট কার্ড নিয়ে ৪৫ হাজার টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন আল-আমিন। 

তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা সবকিছু অস্বীকার করেছেন। বরং আল-আমিনের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরির গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। 

অ্যামাজোপিফাইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুমিনুর রহমান জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় আল-আমিন বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলে চাকরি ছেড়ে দেন। আর রাত্রী বিয়ের কথা বলে চাকরি ছাড়েন। প্রসাদ চাকরি ছাড়েন ব্যবসার কথা বলে। তিনজনের চাকরি ছাড়ার বিষয়টি তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি ছাড়ার পরপরই তিনজনের নামের ইংরেজি বানানের প্রথম অক্ষর দিয়ে ‘এআরপি আইটি সলিউশন’ নামের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান খোলেন তাঁরা। মুমিনুরের অভিযোগ, এ তিনজন তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ক্লায়েন্টদের নাম, ঠিকানা, ই-মেইল ও মোবাইল নম্বরসহ যাবতীয় তথ্য চুরি করেছেন। এরপর আলাদা প্রতিষ্ঠান খুলে ক্লায়েন্টদের ভাগিয়ে নিয়েছেন। এতে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। 

মুমিনুরের দাবি, তাঁর ৫০০ নিয়মিত ক্লায়েন্টসহ মোট ৮০০ ক্লায়েন্টের তথ্য চুরি করা হয়। এরপর রাত্রী ‘ফারহিন’, আল-আমিন ‘ইমরান’ ও প্রসাদ সাহা ‘জয় সাহা’ নামে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ বাগিয়ে নেন। এতে অ্যামাজোপিফাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুমিনুর দাবি অনুযায়ী, আগে তাঁর ৫০০ ক্লায়েন্ট ছিল, এখন ১০০ জনও নেই। কাজও কমেছে। তাই কর্মী সংখ্যা ১৪০ থেকে কমিয়ে ৬০ করতে হয়েছে। গত এক বছরে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর এ জন্য দায়ী তাঁর প্রতিষ্ঠানের সাবেক তিন কর্মী রাত্রী, আল-আমিন ও প্রসাদ। 

মুমিনুর বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের এত ক্ষতি করলেও আমরা কিছুই জানতাম না। সম্প্রতি আমরা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানতে পারি। এরপর আল-আমিন পরীক্ষার জন্য ক্যাম্পাসে এলে তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলি। আমি যেহেতু ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছি, আমাকে দেখে অনেকেই আসে। কিন্তু আল-আমিনকে মারধরের অভিযোগ সত্য নয়। সেদিন আল-আমিন স্বীকার করেছে যে তারা তিনজন আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করেছে। আল-আমিন ক্ষতি পুষিয়েও দিতে চেয়েছে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাঠিয়েছে। আল-আমিন যেহেতু ঘটনা ভিন্ন খাতে নিচ্ছে, তাই আমরা আমাদের অফিসের তথ্য চুরির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ 

তবে তথ্য চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আল-আমিন। তিনি বলেন, ‘তথ্য চুরি করেছি, এটা ঠিক না। এটা ডিজিটাল মার্কেট। এক জায়গার ক্লায়েন্ট অন্য জায়গায় আসতেই পারে। সে কারণে আমাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে মারধর করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আলাদা প্রতিষ্ঠান করেছি। এখানে রাত্রী এবং প্রসাদও কাজ করেন। তবে আমাদের কারও কোনো পদ নেই।’ 

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য রাত্রীকে ফোন কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। 

আল-আমিনের দেওয়া অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, ‘কুরিয়ারের মাধ্যমে একটি অভিযোগ এসেছে। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক সহকারী প্রক্টর ড. শাহনেওয়াজ পারভেজ এবং সদস্য হিসেবে আছেন সহকারী প্রক্টর ড. পুরনজিৎ মহলদার ও ড. জহুরুল আনিস। তাঁরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন। তারপর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত