Ajker Patrika

১৮ মাস পরে বাড়ি ফিরে দেখেন, তাঁদের কিছুই নেই

মিজানুর রহমান নয়ন, কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি
আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২১, ১৪: ৪৭
১৮ মাস পরে বাড়ি ফিরে দেখেন, তাঁদের কিছুই নেই

দীর্ঘ আঠারো মাস পরে গ্রামে ফিরেছেন তাঁরা। ফিরে দেখেন তাঁদের ঘরবাড়ি, দালানকোঠা ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ঘরে থাকা আসবাবপত্রের কোনো চিহ্ন নেই। বাড়ির চারপাশের গাছগুলো আর নেই। যত দূর চোখ যায়, শুধু লতাপাতায় ঘেরা জঙ্গল আর জঙ্গল।  দেখে মনে হবে এ যেন যুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত এক গ্রাম।

সভ্য সমাজেও এমন নিষ্ঠুর বর্বর চিত্র কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে। অথচ আঠারো মাস আগেও এখানে ছিল মানুষের কোলাহল। কাঁচা পাকা কয়েকশত ঘরবাড়ি ও শত শত মানুষের বসবাস।

তবে অনেক দেরিতে হলেও প্রশাসনের সহযোগিতায় তাঁরা আবার গ্রামে ফিরেছেন। জঙ্গল কেটেকুটে পুনরায় আবাসস্থল গড়ার চেষ্টা করছেন। জরাজীর্ণ পরিবেশে শুরু করেছেন বসবাস।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো দাবি করেছে, প্রতিপক্ষরা তাঁদের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। কিন্তু প্রতিপক্ষরা বলেছে, ঘটনার পর তিন মাস এলাকায় পুলিশ ছিল। কে বা কারা এই জঘন্য কাজ করেছে তা তাদের জানা নেই।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, আধিপত্য বিস্তার, সমাজপতিদের দলাদলি ও উসকানিতে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে নেহেদ আলী (৬৫) ও বকুল আলী (৫৫) নামের আপন দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনার পরদিন নিহত নেহেদ আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে ২৮ জনকে আসামি করে কুমারখালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় গ্রেপ্তারের ভয়ে আসামিরা এবং এ ঘটনায় প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার।

তাঁদের পালানোর সুযোগে ইট-পাথরের তৈরি পাকা ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে সব স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরে থাকা সব ধরনের আসবাবপত্র, কৃষি ফসলাদি, গৃহপালিত পশু-পাখি, সোনার গয়না, নগদ টাকাসহ যাবতীয় সামগ্রী লুটপাট করে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

শুধু তাই নয়, দিনে দিনে ভাঙা ঘরের ইট, কাঠ ও মাটি পর্যন্ত লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া বড় বড় কাঠের বাগানসহ সব গাছ ও বাঁশ কেটে নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে আঠারো মাস পরে ফেরা পাহারপুর গ্রামের মৃত হেকমতের ছেলে আলমগীর হোসেন বলেন, 'আমি একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। ঘটনার সময় মার্কেটে ছিলাম। মুঠোফোনে জানতে পারি এলাকায় জোড়া খুন হয়েছে। পরে সেই খুনের মামলায় আমাকে ১১ নম্বর আসামি করা হয়েছে।'

আলমগীর আরও বলেন, 'মামলায় গ্রেপ্তারের ভয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে ছিলাম। সেই সুযোগে প্রতিপক্ষের লোকজন পাকা, কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে চার শ মেহগনি গাছের একটি বাগান ছিল। তিন বিঘা জমিতে পুকুর ছিল। সব লুটপাট হয়ে গেছে।'

ওই গ্রামের রুস্তম আলী শেখের স্ত্রী আলেয়া খাতুন বলেন, ' আমরা ঘটনায় জড়িত নই। তবু সেদিন রাতে মুখ বাঁধা কিছু লোক বাড়িতে হামলা চালিয়ে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার দুই লাখ টাকা ও গয়না লুট করে নেয় এবং আমার বিয়ের উপযোগী দুই মেয়ে ও অসুস্থ স্বামীকে বেধড়ক মারপিট করে তাড়িয়ে দেয়। 'আলেয়া খাতুন আরও বলেন, 'আমার দুই ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। এত দিন সেখানে থাকতাম। এখন প্রশাসনের সহযোগিতায় বাড়িতে এসেছি। কিন্তু ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র কিছুই বাড়িতে নেই। তবু নতুন করে বসবাস শুরু করতে চাই। সরকার যেন আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।'

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, 'তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এলাকায় যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। আমরাও চাই প্রকৃত দোষীদের বিচার হোক। কিন্তু যারা নিরপরাধ, নির্দোষ, তারা কেন মামলার আসামি হবে, ভোগান্তি পোহাবে, এলাকাছাড়া হবে? তাঁরা আরও বলেন, 'একজন অপরাধ করতে পারে, কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা তো অপরাধী নয়! ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, পশুপাখি, গাছপালা, বাড়ির আসবাবপত্র তো অপরাধী নয়!'

বুধবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একসময় জনাকীর্ণ পাহাড়পুর গ্রামের অর্ধেক অংশ লতাপাতায় জঙ্গলে ভরা। শুধু ঘরবাড়িগুলোর ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। ফেরত আসা পরিবারগুলোর কেউ বাঁশ কাঁটছে। কেউ আবার জরাজীর্ণ থাকার ঘর তৈরি করছে। 

এ ছাড়া গ্রামে পুলিশের টহল গাড়ি ও দুজন পুলিশ সদস্যকে দাঁয়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।

মামলার ২৩ নম্বর আসামি মাসুদ রানার স্ত্রী বলেন, 'আমার স্বামী ময়মনসিংহে চাকরি করে। সেখানেই আমরা থাকি। ঘটনার দিন সেখানে থেকে মার্ডার মামলার আসামি হয়েছে স্বামী। আর কে বা কারা ঘরবাড়ি ভেঙে গাছগাছালিসহ মালামাল লুট করেছে।'

ভুক্তভোগী আব্দুর রহমান বলেন, 'আমি একজন কৃষক। আট বিঘা জমিতে চাষাবাদ করি। আমি মামলার আসামি নই, তবু আমার ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে। নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু করেছি।'

জোড়া খুন মামলার বাদী বলেন, 'আমার পরিবার শোকাহত। আমরা কারও ঘরবাড়ি ভাঙিনি। লুটপাটও করিনি। ঘটনার পর প্রায় তিন মাস এলাকায় পুলিশ ছিল।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সঙ্গে সামাজিকভাবে সমঝোতা না করে হঠাৎ পুলিশ আসামিপক্ষের বাড়ি তুলে দিয়েছে। তৃতীয় পক্ষ কোনো  সুযোগ নিলে কে এর দায়ভার নেবে?'

কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, 'আসামিরা জামিন নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে।'

ওসি আরও বলেন, ' ঘটনা আমি যোগদানের পূর্বে। তাই কে কী  করেছে জানা নেই। তবে মিলেমিশে বসবাসের জন্য উভয় পক্ষকে ডাকা হয়েছে।'

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত