Ajker Patrika

সেই থেকে নিখোঁজ লিয়াকত

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ১১
সেই থেকে নিখোঁজ লিয়াকত

২০০৩ সালের ১ অক্টোবর, বুধবার। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক থেকে ৩২ নম্বর ব্রিজ পর্যন্ত সর্বত্র অচেনা মানুষের আনাগোনা। কেউ ঝাড়ুদার, কেউ ট্যাক্সিচালক, কেউ বাদাম বিক্রেতা, কেউ-বা ভিক্ষুক। সবাই শ্যেনদৃষ্টিতে অপেক্ষা করছেন।

ছদ্মবেশ নেওয়া সবাই আসলে পুলিশের বিশেষ বাহিনী ‘র‍্যাট’-এর সদস্য। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সহকারী পুলিশ কমিশনার নাজমুল হাসান ভালো করে দেখে নেন, ৪০ জনের এই দলের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। বিকেল ৪টা বেজে কয়েক মিনিট, রুপালি রঙের একটি গাড়ি ধানমন্ডি ২৭ থেকে ৩২ নম্বর সড়কের দিকে মোড় নিচ্ছে। সবাই বুঝতে পারেন, এই গাড়িতেই শিকার। দলের একটি ট্যাক্সিক্যাব কারটি অনুসরণ করতে থাকে। বেতারবার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় সবাইকে, যাতে সতর্ক থাকেন।

একটু পর গাড়িটি ৩২ নম্বর সড়কের শেষ মাথা পেরিয়ে ব্রিজের ওপর ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি হলুদ ট্যাক্সিক্যাব এসে সামনে দাঁড়ায়। গাড়িচালক অবস্থা বুঝে ব্যারিকেড দেওয়া গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে র‍্যাপিড অ্যাকশন টিমের সদস্যরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা কয়েকজন পুলিশ কমান্ডো স্টাইলে গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। গাড়ি থেকে বের করে আনা হয় যে ব্যক্তিকে, তাঁর নাম লিয়াকত হোসেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তিনি সরকারের তালিকাভুক্ত। লিয়াকত গ্রেপ্তারের খবর আসে সংবাদপত্র অফিসে। আমরা ছুটে যাই র‍্যাটের ধানমন্ডির অফিসে। তার আগে র‍্যাট প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি।

২০০৪ সালে র‍্যাব গঠনের আগে চারদলীয় জোট সরকার আরেকটি বিশেষায়িত বাহিনী তৈরি করেছিল, যার নাম ছিল র‍্যাট বা র‍্যাপিড অ্যাকশন টিম। পুলিশ সুপার মাজহারুল হক ছিলেন র‍্যাটের প্রধান। শুরুতে এই বাহিনী বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বাহিনীর নাম নিয়ে পুলিশের মধ্যে হাসাহাসি শুরু হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলতেন ‘ইঁদুর বাহিনী’।

পরে সেই নাম বদলে করা হয় র‍্যাব। তবে এটা বলা যেতে পারে, র‍্যাব গঠনের আগে র‍্যাট ছিল জোট সরকারের ‘টেস্ট কেস’।

তো আমরা র‍্যাট অফিসে গিয়ে দেখি, লিয়াকতের সঙ্গে তাঁর দেহরক্ষী ও চাচাতো ভাই সোহাগ সর্দার এবং গাড়িচালক বাদল হাওলাদারকে আটক করা হয়েছে। সাংবাদিকদের দাবির মুখে লিয়াকতের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেন র‍্যাট কর্মকর্তারা।

লিয়াকত হোসেন আমাদের বলেন, অনেক দিন কলকাতায় ছিলেন। এক মাস আগে তাঁর মা মমতাজ বেগম মারা যান। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। এরপর থেকে মোহাম্মদপুরে বায়তুল আমান হাউজিংয়ে তাঁর খালাতো ভাইয়ের বাসায় ছিলেন। গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার জন্য এত দিন সাবধানে চলাফেরা করেছেন। মুকুল চৌধুরী নামে ধানমন্ডির এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর কাছে তিনি টাকা পেতেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি টাকা না দিয়ে টালবাহানা করছিলেন। ঘটনার দিন ওই টাকা দেওয়ার কথা ছিল। টাকা আনতেই তিনি মুকুল চৌধুরীর বাসায় যাচ্ছিলেন। কিন্তু মুকুল তাঁকে ধরিয়ে দেবেন, তা তিনি ধারণাও করতে পারেননি।

লিয়াকত বলেছিলেন, তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণার পর তিন মাস ঢাকায় ছিলেন। এ সময় তিনি উচ্চ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের চেষ্টা করেন। কিন্তু আইনজীবীরা তাঁকে আশ্বাস না দেওয়ায় আত্মসমর্পণ না করে কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি গ্রেপ্তার হলেও পরে মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

দলের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের জন্য তিনি যথেষ্ট ত্যাগ করেছেন। বছরের পর বছর কারাভোগ করেছেন। বিনিময়ে দল থেকে কিছু পাননি; বরং আওয়ামী লীগই তাঁর নামের সঙ্গে সন্ত্রাসী শব্দটা জুড়ে দিয়েছে। আর বর্তমান জোট সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করছে। এই সুবাদেই আজ তিনি ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন।

লিয়াকতের সেই গ্রেপ্তার বেশ লম্বা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর র‍্যাট সদস্যরা জানিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৯টি মামলা ও চারটি জিডি আছে। কিন্তু এসব মামলার একটিতেও তাঁকে কখনো গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। গ্রেপ্তারের পর পাঁচ বছরে ২২ দফা আটকাদেশ দিয়ে তাঁকে জেলে রাখা হয়। লিয়াকতের সেই আটকাদেশের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালে তাঁর পরিবার রিট করে। ২০০৮ সালের আগস্টে আদালত তাঁর আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান লিয়াকত। কারা প্রশাসনের উপমহাপরিদর্শক মেজর সামসুল হায়দার ছিদ্দিকী তাঁর মুক্তির খবর আমাকে দিয়েছিলেন।

কারাগার থেকে বের হওয়ার পর নিজের ইস্কাটনের বাড়ি ছেড়ে ধানমন্ডি ২৭ (পুরাতন) নম্বর রোডে শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন লিয়াকত। তিনি কারও সঙ্গে মিশতেন না, টেলিফোনে কথাও বলতেন না। দুই মাস এভাবে থাকার পর একদিন সাদা পোশাকের একদল লোক তাঁকে তুলে নিয়ে যান। সেই গল্পে পরে আসছি।

মাদারীপুরের শিবচরের ভান্ডারিকান্দি গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে লিয়াকতের জন্ম। ছয় ভাই, এক বোন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। চাচা প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। ছোট ভাই নান্নু নিজ গ্রামে কয়েক দফা ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আরেক ভাই হান্নান যুবলীগের কমিটিতে কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। বোন পারুল আখতার যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন।

গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হতে ঢাকায় আসেন লিয়াকত। এসেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র না হলেও সঙ্গী হান্নানকে নিয়ে তিনি ঢাকা কলেজ হোস্টেলের দুটি কক্ষ দখল করে থাকতে শুরু করেন। তবে এরশাদ শাসনের আমল পর্যন্ত টানা দুই দশক লিয়াকত ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেন। এরপর যুবলীগের হাল ধরেন। ঢাকাসহ দেশব্যাপী তাঁর নিজস্ব কর্মী বাহিনী ছিল। রাজনীতির মাঠেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় হেমায়েতউল্লাহ আওরঙ্গ ও আমির হোসেন আমুর।

১৯৯০-এর পরে ঢাকায় নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন লিয়াকত। সেই বাহিনীর লোকজন নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে শুরু করে। শুরুতে লিয়াকতের ভাই নান্নু নীলক্ষেত এলাকায় চাঁদাবাজি করতেন। সেটা ধীরে ধীরে এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন হয়ে ইস্কাটন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ইস্কাটনে প্রতিবন্ধী স্কুলের পাশে একটি বাড়ি দখল করে সেখানে ক্লাবঘর করেন। সেই ক্লাবে বসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতেন। পরে থিতু হন বাংলামোটরে হেলেনা সেন্টারে। ইস্কাটনের মোনা টাওয়ারে পরিবার নিয়ে থাকতে শুরু করেন।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে একপর্যায়ে হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। সেই দলে যুক্ত হন মগবাজারের আরমান। তাঁরা বিমানবন্দরের সোনা চোরাচালানেও জড়িয়ে পড়েন। এতে বাদ সাধেন আরেক সন্ত্রাসী টোকাই সাগর। ফলে দুই পক্ষে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এরপর পাঁচ সন্ত্রাসীকে নিয়ে গড়ে তোলেন ফাইভ স্টার বাহিনী। একে সামাল দিতে টোকাই সাগর ও সুব্রত বাইন মিলে গড়ে তোলেন সেভেন স্টার বাহিনী। এ দুই বাহিনীর মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই গোলাগুলি হতো। সেই বিরোধের মধ্যে ২০০০ সালের ১৮ মে ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় খুন হন মুরগি মিলন। এরপর আরমান গা ঢাকা দেন। একা হয়ে যান লিয়াকত। তবে তাঁর এসব কর্মকাণ্ডে বিব্রত ছিল সরকার। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০০ সালের ২০ অক্টোবর রমনা থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মুক্তি পান ২০০১-এর নির্বাচনের কিছুদিন আগে।

২০০১ সালে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ক্ষমতায় এসে ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। লিয়াকতকে ধরিয়ে দিতে ঘোষণা করা হয় এক লাখ টাকার পুরস্কার। এই ঘোষণার পর ফেরারি হন লিয়াকত। পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে থাকাকালীন কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ২০০২ সালের ১৯ নভেম্বর কলকাতার আদালত তাঁকে জামিনে মুক্তি দেন। ফিরে আসেন ২০০৩ সালে, র‍্যাটের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন আগে।

পাঁচ বছর জেল খেটে বের হওয়ার পর ২০০৮ সালের ২৫ নভেম্বর সাদা পোশাকের একদল লোক তাঁকে তুলে নিয়ে যান ধানমন্ডির শ্বশুরবাড়ি থেকে। লিয়াকতের স্ত্রী ফারহানা হোসেন আমাকে বলেছিলেন, ভোর পৌনে ৬টার দিকে সাদা পোশাকধারী ছয়-সাত জন বাসার নিরাপত্তাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের বাসায় আসেন। তাঁরা বাসায় ঢুকে লিয়াকত কোন কক্ষে থাকেন তা জানতে চান। এরপর লিয়াকতকে পেয়েই তাঁর মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে এবং হাত পিছমোড়া বেঁধে দ্রুত একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। লিয়াকতের পাঁচটি মোবাইল ফোনসেটও নিয়ে যান তাঁরা।

সেই যে গেলেন, আর ফিরে আসেননি লিয়াকত। কোথায় হারিয়ে গেলেন ‘ক্ষমতাধর’ লিয়াকত, কেউ জানে না।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত