কামরুল হাসান
ভালো একটা নিউজের গন্ধ পেয়ে গেলাম চট্টগ্রামে। দুই দিন বেশ ঘোরাঘুরি করলাম, কিন্তু জুতসই কোনো কিছু দাঁড়াল না। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসব বলে ঠিক করে বিকেলের দিকে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। গোধূলি নামের যে গেস্টহাউসে উঠেছি, দেখি আমার পাশের কক্ষে পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তা। সেই যে কথায় আছে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গল্পগুজব। আমার মতো তিনিও রাতে ঢাকায় ফিরবেন। হাতে এখনো অনেক সময়। আমার আপাতত কোনো কাজ নেই। তিনি যাবেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক প্রবাসী বন্ধুকে দেখতে। তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সওয়ারি হয়ে গেলাম।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পশ্চিম দিকের পাঁচতলায় বিশাল এলাকা নিয়ে কেবিন ব্লক, তাঁর সেই বন্ধু সেখানেই ভর্তি। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে আমি বাইরে এলাম, তিনি বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। হাসপাতালের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত টানা বারান্দা। সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। সেই খোলা বারান্দায় হাওয়া খেতে খেতে দেখি, একটা কেবিনের দরজার সামনের চেয়ারে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে একজন কারারক্ষী বসে আছেন। আরেকজন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। তাঁরা কথা বলছেন আর একটু পরপর হেসে উঠছেন। এভাবে সাত-আট মিনিট যেতে না যেতেই এক বয়স্ক লোক খাবারভর্তি ক্যারিয়ার নিয়ে সেখানে এলেন। তিনি কারও সঙ্গে কথা না বলে সোজা ভেতরে ঢুকে গেলেন। কারারক্ষীরা যেভাবে গল্প করছিলেন, সেভাবেই করতে থাকলেন। দুই-তিন মিনিট পর খাবার নিয়ে আসা লোকটা কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে নিচে নামার সিঁড়ি। লোকটি সিঁড়ির মুখে আসতেই তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আপনি কি কোনো আসামির জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন? তিনি কোনো কথা না বলে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে লাগলেন।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তিনি নিচে নামলেন না। অর্ধেক সিঁড়ি নেমে আবার ওপরে উঠে এলেন। এরপর সোজা চলে গেলেন সেই কেবিনের দুই কারারক্ষীর কাছে। তাঁদের কাছে গিয়ে কী যেন বলে হনহন করে হাঁটা দিলেন। লোকটার গতিবিধি আমার কাছে খুব অবাক লাগল।
লোকটা চলে যাওয়ার পর আমি দুই কারারক্ষীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, এই কেবিনে কি কোনো আসামি থাকেন? দুই কারারক্ষী আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, আপনার পরিচয় কী? কেন এসব জানতে চান? অগত্যা সাংবাদিক পরিচয় দিলে তাঁরা বললেন, আপনার কোনো কিছু জানার থাকলে কারাগারের জেলার বা সুপারকে ফোন দেন। আমরা কিছু জানি না। আমি আসামির নাম জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, তাঁরা নাম জানেন না। আমার সঙ্গে কারারক্ষীদের কথা বলার সময় কেবিনের সব আলো নিভে গেল।
আমার পরিচিত সেই পুলিশ কর্মকর্তা ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁকে বললাম, আপনি চলে যেতে পারেন, আমার একটু দেরি হবে। আমাদের দুজনের একসঙ্গে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু আমার কথা শুনে তিনি বললেন, আপনি কি রাতে ঢাকায় যাচ্ছেন না? আমি বললাম, একটু পরে বলতে পারব। তিনি কিছু না বলে চলে গেলেন।
সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর হদিস বের করা ক্রাইম রিপোর্টারদের কাছে কোনো কাজই না। সেই সব টেকনিক কাজে লাগাতে শুরু করলাম। সোজা চলে গেলাম কেবিনের নার্সদের রুমে। জানতে চাইলাম ১৭ নম্বর কেবিনের রোগীর নাম কী? নার্স ১৭ নম্বর কেবিনের ফাইলটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন, তিনি আগে ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২২ নম্বর কেবিনে ছিলেন। কয়েক দিন হলো এই কেবিনে। আমি আবারও জানতে চাইলাম, নাম কী? তিনি কিছুটা আমতা-আমতা করে বললেন, ইয়াসিন রহমান টিটো। তিনি কার অধীনে ভর্তি জানতে চাইলে নার্স বললেন, নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান কামাল উদ্দিন ও সহকারী অধ্যাপক আনিসুল ইসলাম খান তাঁকে দেখছেন। রোগ কী? বললেন, পিঠে ব্যথা।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে এটাই আমার প্রথম আসা। খুঁজে বের করলাম নিউরোসার্জারি বিভাগ। কিন্তু দুজন চিকিৎসকের কেউই হাসপাতালে নেই। কয়েকজনের কাছে ফোন নম্বর চাইলাম, কেউ দিতে রাজি হলেন না। আবার ফিরে এলাম কেবিনের সামনে। দেখি ১৭ নম্বর কেবিনের মুখোমুখি যে কেবিন, সেই কেবিন থেকে দুই ব্যক্তি বের হয়ে যাচ্ছেন। দেখে মনে হলো তাঁরা স্থানীয়। তাঁদের একজনের কাছে জানতে চাইলাম, ১৭ নম্বর কেবিন সম্পর্কে কিছু জানেন? দুজন কিছু বলতে চাইছিলেন, আমি সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তাঁরা আমার সঙ্গে বারান্দার দিকে এলেন। একজন বললেন, এই বন্দী হলেন চট্টগ্রামের শিল্পপতি ও কেডিএস গ্রুপের মালিক খলিলুর রহমানের ছেলে টিটো। জিবরান তায়েবি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আরেকজন বললেন, ‘উনি যে বন্দী, তা বোঝার উপায় নেই। একটু কেবিনের ভেতরে ঢুকে দেখেন, কী নেই—ল্যাপটপ, ফোন—সবই আছে। রাতে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডাও জমান। বড়লোক বাবা আছেন, সবকিছু ম্যানেজ করছেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারের কেবিনে ভিআইপি হয়ে আছেন।’ তাঁদের কথা শুনে উত্তেজনা বেড়ে গেল। গোধূলি গেস্টহাউসের ম্যানেজারকে ফোন করে বললাম, আজ রাতে ঢাকায় যাচ্ছি না, রুম থাকবে।
ইনডিপেনডেন্ট টিভির বার্তাপ্রধান মামুন আবদুল্লাহ তখন চট্টগ্রাম ব্যুরোর দায়িত্বে। তাঁকে ফোন করে টিটোর কথা বলতেই তিনি অফিসে যেতে বলেন। গেলাম ইনডিপেনডেন্ট টিভির লাভ লেনের অফিসে। মামুন আবদুল্লাহ সবকিছু শুনে দুই মিনিটের মধ্যে কয়েকটি লিংক মেইল করে দিয়ে বললেন, এর ভেতরে ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আবার ছুটলাম গরিবুল্লাহ মাজারের কাছে গেস্টহাউসে।
রুমে ফিরে লিংকগুলো খুলে দেখি, জিবরান তায়েবি হলেন জাহাজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট্রান্স মেরিটাইম (বিডি) লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা টি এ খানের একমাত্র ছেলে। ১৯৯৯ সালের ৯ জুন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কার্যালয় থেকে খুলশীর বাসায় ফেরার পথে তিনি খুন হন। সেই মামলায় পুলিশ শিল্পপতির পুত্রসহ আটজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রামের আরেক শিল্পপতির মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ঘটনা নিয়ে ইয়াসিন রহমান টিটো ও তাঁর সঙ্গীরা জিবরানকে খুন করেন। কিন্তু নিম্ন আদালতে বিচারে শিল্পপতির পুত্রকে বেকসুর খালাস দিয়ে অন্য ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। উচ্চ আদালত শিল্পপতির পুত্রকেও যাবজ্জীবন সাজা দেন। হাইকোর্টের রায় ঘোষণা পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর শিল্পপতির পুত্র আত্মগোপনে থাকেন। ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এ নিয়ে আপিলও হয়েছিল, কিন্তু রায় আর নড়চড় হয়নি।
আত্মসমর্পণ করে শিল্পপতির পুত্র কারাগারে গেলেও মাত্র তিন দিন কারাগারে ছিলেন। বাকি এক বছর আড়াই মাস বা ৪৪০ দিন তিনি হাসপাতালেই আছেন। ২০১৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আমি সেখানে গিয়ে শুনেছিলাম, তাঁর রোগ বলতে ছিল ‘পিঠে ব্যথা’।
গেস্টহাউস থেকে পরদিন সকালে নাশতা করেই দৌড় দিলাম হাসপাতালে। হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে পেয়ে গেলাম সহকারী অধ্যাপক আনিসুল ইসলাম খানকে। তাঁর কাছে রোগী ও রোগ সম্পর্কে জানতে চাইতেই তিনি বললেন, ‘সবই তো বোঝেন, ভাই’। গেলাম পরিচালকের কাছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তখন পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল গনি। তিনি বললেন, ‘আরে ভাই, রোগীর চিকিৎসা করেন চিকিৎসক, পরিচালক তো নয়।’ এভাবে যত কথা বলছি, মনে হচ্ছে কোনো এক অদৃশ্য কারণে সবাই সবকিছু জেনেও এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।
হাসপাতাল থেকে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে গেলাম চট্টগ্রাম কারাগারে। সেখানকার জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ছগীর মিয়া আমার পরিচিত। তিনি রোগীর সব তথ্য দিয়ে বললেন, ‘হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে রোগীর ছাড়পত্র দিতে বলেছেন। দফায় দফায় চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু বন্দী আর কারাগারে ফিরে আসেননি।’ তাঁর কথা শুনে মনে হলো, শিল্পপতির পুত্রের এভাবে মাসের পর মাস হাসপাতালে অবস্থানের ঘটনা নিয়ে বিব্রত কারা প্রশাসন। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই।
আমার সব কাজ শেষ, এবার ফোন দিলাম কারাবন্দী টিটোর বাবা শিল্পপতি খলিলুর রহমানকে। তিনি আমার কাছ থেকে সবকিছু শুনে কোনো মন্তব্য না করে ফোন রেখে দিলেন। ভেবে নিলাম, আমার কাজ শেষ। এবার নিউজ লিখে পাঠাতে যত দেরি। কিন্তু তাঁর ফোন রাখতেই শুরু হলো তদবির। একের পর এক ফোন আসতে লাগল। সবার আবদার—নিউজ যেন না করা হয়। পরদিন লিড হলো, ‘যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ১৪ মাস হাসপাতালে’।
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারির সকাল। তখনো পত্রিকা দেখিনি। কারাগার থেকে জেলারের ফোন। বলেন, কারা অধিদপ্তরে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। দ্রুত হাসপাতালে আসেন, আসামিকে এখনই কারাগারে ফিরিয়ে আনা হবে।
গেলাম হাসপাতালে। আবার আমি হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে এসে লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, ক্ষমতার সকল দর্প চূর্ণ করে মহাক্ষমতাধর এক আসামিকে কারাগারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সেদিন মনে হয়েছিল, খবরের অনেক শক্তি। সেই শক্তির কাছে মহাক্ষমতাধরেরা পরাজিত হয়। কিন্তু আজ মনে হয়, সেটা একেবারেই ঠিক নয়। আজকের বদলে যাওয়া সময়ের মুখে খবরের মানুষগুলো সত্যিই বড় অসহায়।
আরও পড়ুন:
ভালো একটা নিউজের গন্ধ পেয়ে গেলাম চট্টগ্রামে। দুই দিন বেশ ঘোরাঘুরি করলাম, কিন্তু জুতসই কোনো কিছু দাঁড়াল না। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসব বলে ঠিক করে বিকেলের দিকে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। গোধূলি নামের যে গেস্টহাউসে উঠেছি, দেখি আমার পাশের কক্ষে পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তা। সেই যে কথায় আছে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গল্পগুজব। আমার মতো তিনিও রাতে ঢাকায় ফিরবেন। হাতে এখনো অনেক সময়। আমার আপাতত কোনো কাজ নেই। তিনি যাবেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক প্রবাসী বন্ধুকে দেখতে। তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সওয়ারি হয়ে গেলাম।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পশ্চিম দিকের পাঁচতলায় বিশাল এলাকা নিয়ে কেবিন ব্লক, তাঁর সেই বন্ধু সেখানেই ভর্তি। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে আমি বাইরে এলাম, তিনি বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। হাসপাতালের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত টানা বারান্দা। সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। সেই খোলা বারান্দায় হাওয়া খেতে খেতে দেখি, একটা কেবিনের দরজার সামনের চেয়ারে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে একজন কারারক্ষী বসে আছেন। আরেকজন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। তাঁরা কথা বলছেন আর একটু পরপর হেসে উঠছেন। এভাবে সাত-আট মিনিট যেতে না যেতেই এক বয়স্ক লোক খাবারভর্তি ক্যারিয়ার নিয়ে সেখানে এলেন। তিনি কারও সঙ্গে কথা না বলে সোজা ভেতরে ঢুকে গেলেন। কারারক্ষীরা যেভাবে গল্প করছিলেন, সেভাবেই করতে থাকলেন। দুই-তিন মিনিট পর খাবার নিয়ে আসা লোকটা কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে নিচে নামার সিঁড়ি। লোকটি সিঁড়ির মুখে আসতেই তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আপনি কি কোনো আসামির জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন? তিনি কোনো কথা না বলে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে লাগলেন।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তিনি নিচে নামলেন না। অর্ধেক সিঁড়ি নেমে আবার ওপরে উঠে এলেন। এরপর সোজা চলে গেলেন সেই কেবিনের দুই কারারক্ষীর কাছে। তাঁদের কাছে গিয়ে কী যেন বলে হনহন করে হাঁটা দিলেন। লোকটার গতিবিধি আমার কাছে খুব অবাক লাগল।
লোকটা চলে যাওয়ার পর আমি দুই কারারক্ষীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, এই কেবিনে কি কোনো আসামি থাকেন? দুই কারারক্ষী আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, আপনার পরিচয় কী? কেন এসব জানতে চান? অগত্যা সাংবাদিক পরিচয় দিলে তাঁরা বললেন, আপনার কোনো কিছু জানার থাকলে কারাগারের জেলার বা সুপারকে ফোন দেন। আমরা কিছু জানি না। আমি আসামির নাম জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, তাঁরা নাম জানেন না। আমার সঙ্গে কারারক্ষীদের কথা বলার সময় কেবিনের সব আলো নিভে গেল।
আমার পরিচিত সেই পুলিশ কর্মকর্তা ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁকে বললাম, আপনি চলে যেতে পারেন, আমার একটু দেরি হবে। আমাদের দুজনের একসঙ্গে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু আমার কথা শুনে তিনি বললেন, আপনি কি রাতে ঢাকায় যাচ্ছেন না? আমি বললাম, একটু পরে বলতে পারব। তিনি কিছু না বলে চলে গেলেন।
সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর হদিস বের করা ক্রাইম রিপোর্টারদের কাছে কোনো কাজই না। সেই সব টেকনিক কাজে লাগাতে শুরু করলাম। সোজা চলে গেলাম কেবিনের নার্সদের রুমে। জানতে চাইলাম ১৭ নম্বর কেবিনের রোগীর নাম কী? নার্স ১৭ নম্বর কেবিনের ফাইলটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন, তিনি আগে ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২২ নম্বর কেবিনে ছিলেন। কয়েক দিন হলো এই কেবিনে। আমি আবারও জানতে চাইলাম, নাম কী? তিনি কিছুটা আমতা-আমতা করে বললেন, ইয়াসিন রহমান টিটো। তিনি কার অধীনে ভর্তি জানতে চাইলে নার্স বললেন, নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান কামাল উদ্দিন ও সহকারী অধ্যাপক আনিসুল ইসলাম খান তাঁকে দেখছেন। রোগ কী? বললেন, পিঠে ব্যথা।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে এটাই আমার প্রথম আসা। খুঁজে বের করলাম নিউরোসার্জারি বিভাগ। কিন্তু দুজন চিকিৎসকের কেউই হাসপাতালে নেই। কয়েকজনের কাছে ফোন নম্বর চাইলাম, কেউ দিতে রাজি হলেন না। আবার ফিরে এলাম কেবিনের সামনে। দেখি ১৭ নম্বর কেবিনের মুখোমুখি যে কেবিন, সেই কেবিন থেকে দুই ব্যক্তি বের হয়ে যাচ্ছেন। দেখে মনে হলো তাঁরা স্থানীয়। তাঁদের একজনের কাছে জানতে চাইলাম, ১৭ নম্বর কেবিন সম্পর্কে কিছু জানেন? দুজন কিছু বলতে চাইছিলেন, আমি সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তাঁরা আমার সঙ্গে বারান্দার দিকে এলেন। একজন বললেন, এই বন্দী হলেন চট্টগ্রামের শিল্পপতি ও কেডিএস গ্রুপের মালিক খলিলুর রহমানের ছেলে টিটো। জিবরান তায়েবি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আরেকজন বললেন, ‘উনি যে বন্দী, তা বোঝার উপায় নেই। একটু কেবিনের ভেতরে ঢুকে দেখেন, কী নেই—ল্যাপটপ, ফোন—সবই আছে। রাতে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডাও জমান। বড়লোক বাবা আছেন, সবকিছু ম্যানেজ করছেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারের কেবিনে ভিআইপি হয়ে আছেন।’ তাঁদের কথা শুনে উত্তেজনা বেড়ে গেল। গোধূলি গেস্টহাউসের ম্যানেজারকে ফোন করে বললাম, আজ রাতে ঢাকায় যাচ্ছি না, রুম থাকবে।
ইনডিপেনডেন্ট টিভির বার্তাপ্রধান মামুন আবদুল্লাহ তখন চট্টগ্রাম ব্যুরোর দায়িত্বে। তাঁকে ফোন করে টিটোর কথা বলতেই তিনি অফিসে যেতে বলেন। গেলাম ইনডিপেনডেন্ট টিভির লাভ লেনের অফিসে। মামুন আবদুল্লাহ সবকিছু শুনে দুই মিনিটের মধ্যে কয়েকটি লিংক মেইল করে দিয়ে বললেন, এর ভেতরে ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আবার ছুটলাম গরিবুল্লাহ মাজারের কাছে গেস্টহাউসে।
রুমে ফিরে লিংকগুলো খুলে দেখি, জিবরান তায়েবি হলেন জাহাজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট্রান্স মেরিটাইম (বিডি) লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা টি এ খানের একমাত্র ছেলে। ১৯৯৯ সালের ৯ জুন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কার্যালয় থেকে খুলশীর বাসায় ফেরার পথে তিনি খুন হন। সেই মামলায় পুলিশ শিল্পপতির পুত্রসহ আটজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রামের আরেক শিল্পপতির মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ঘটনা নিয়ে ইয়াসিন রহমান টিটো ও তাঁর সঙ্গীরা জিবরানকে খুন করেন। কিন্তু নিম্ন আদালতে বিচারে শিল্পপতির পুত্রকে বেকসুর খালাস দিয়ে অন্য ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। উচ্চ আদালত শিল্পপতির পুত্রকেও যাবজ্জীবন সাজা দেন। হাইকোর্টের রায় ঘোষণা পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর শিল্পপতির পুত্র আত্মগোপনে থাকেন। ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এ নিয়ে আপিলও হয়েছিল, কিন্তু রায় আর নড়চড় হয়নি।
আত্মসমর্পণ করে শিল্পপতির পুত্র কারাগারে গেলেও মাত্র তিন দিন কারাগারে ছিলেন। বাকি এক বছর আড়াই মাস বা ৪৪০ দিন তিনি হাসপাতালেই আছেন। ২০১৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আমি সেখানে গিয়ে শুনেছিলাম, তাঁর রোগ বলতে ছিল ‘পিঠে ব্যথা’।
গেস্টহাউস থেকে পরদিন সকালে নাশতা করেই দৌড় দিলাম হাসপাতালে। হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে পেয়ে গেলাম সহকারী অধ্যাপক আনিসুল ইসলাম খানকে। তাঁর কাছে রোগী ও রোগ সম্পর্কে জানতে চাইতেই তিনি বললেন, ‘সবই তো বোঝেন, ভাই’। গেলাম পরিচালকের কাছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তখন পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল গনি। তিনি বললেন, ‘আরে ভাই, রোগীর চিকিৎসা করেন চিকিৎসক, পরিচালক তো নয়।’ এভাবে যত কথা বলছি, মনে হচ্ছে কোনো এক অদৃশ্য কারণে সবাই সবকিছু জেনেও এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।
হাসপাতাল থেকে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে গেলাম চট্টগ্রাম কারাগারে। সেখানকার জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ছগীর মিয়া আমার পরিচিত। তিনি রোগীর সব তথ্য দিয়ে বললেন, ‘হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে রোগীর ছাড়পত্র দিতে বলেছেন। দফায় দফায় চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু বন্দী আর কারাগারে ফিরে আসেননি।’ তাঁর কথা শুনে মনে হলো, শিল্পপতির পুত্রের এভাবে মাসের পর মাস হাসপাতালে অবস্থানের ঘটনা নিয়ে বিব্রত কারা প্রশাসন। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই।
আমার সব কাজ শেষ, এবার ফোন দিলাম কারাবন্দী টিটোর বাবা শিল্পপতি খলিলুর রহমানকে। তিনি আমার কাছ থেকে সবকিছু শুনে কোনো মন্তব্য না করে ফোন রেখে দিলেন। ভেবে নিলাম, আমার কাজ শেষ। এবার নিউজ লিখে পাঠাতে যত দেরি। কিন্তু তাঁর ফোন রাখতেই শুরু হলো তদবির। একের পর এক ফোন আসতে লাগল। সবার আবদার—নিউজ যেন না করা হয়। পরদিন লিড হলো, ‘যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ১৪ মাস হাসপাতালে’।
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারির সকাল। তখনো পত্রিকা দেখিনি। কারাগার থেকে জেলারের ফোন। বলেন, কারা অধিদপ্তরে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। দ্রুত হাসপাতালে আসেন, আসামিকে এখনই কারাগারে ফিরিয়ে আনা হবে।
গেলাম হাসপাতালে। আবার আমি হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে এসে লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, ক্ষমতার সকল দর্প চূর্ণ করে মহাক্ষমতাধর এক আসামিকে কারাগারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সেদিন মনে হয়েছিল, খবরের অনেক শক্তি। সেই শক্তির কাছে মহাক্ষমতাধরেরা পরাজিত হয়। কিন্তু আজ মনে হয়, সেটা একেবারেই ঠিক নয়। আজকের বদলে যাওয়া সময়ের মুখে খবরের মানুষগুলো সত্যিই বড় অসহায়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীর মিরপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ইমরান খান সাকিব ওরফে শাকিল (৩৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে মিরপুর মডেল থানা-পুলিশ। ডিএমপি জানায়, শাকিল পেশাদার ছিনতাইকারী। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা ১৫ মিনিটের দিকে গাজীপুরের পুবাইল থানার কুদাব পশ্চিমপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়...
১২ দিন আগেরাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলায় ‘আপন কফি হাউসে’ তরুণীকে মারধরের ঘটনায় কফি হাউসের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) আল আমিন ও কর্মচারী শুভ সূত্রধরকে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাকিবুল হাসান এ আদেশ দেন।
১৪ দিন আগেক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ল অমানবিক দৃশ্য— মেয়েটিকে বেশ কিছুক্ষণ ধমকানো হলো। এরপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। সে যেন মানুষ নয়, পথের ধুলো। এর মধ্যেই এক কর্মচারী হঠাৎ মোটা লাঠি নিয়ে আঘাত করে তাঁর ছোট্ট পায়ে। শিশুটি কাতরাতে কাতরাতে পাশের দুটি গাড়ির ফাঁকে আশ্রয় নেয়। কিন্তু নির্যাতন থামে না, সেই লাঠি আব
১৫ দিন আগেটিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘ধর্ষণ’ শব্দ ব্যবহার না করার অনুরোধের মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বাস্তবে ধর্ষকের পক্ষ নিচ্ছেন। তিনি এই বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, অপরাধকে লঘু করার কোনো...
১৬ মার্চ ২০২৫