Ajker Patrika

সাধারণ এক নারীর জীবনবোধ

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৩ জুন ২০২৩, ০৯: ৪২
সাধারণ এক নারীর জীবনবোধ

একদিন রাতে হঠাৎ এক নারীর ফোন। নিজের পরিচয় সম্পর্কে শুধু জানালেন, তিনি ফিরোজ আল মামুনের স্ত্রী। তারপর বললেন, ‘সাংবাদিক সাহেব, বিরাট চাকরি করেন, কাঁড়ি কাঁড়ি বেতন পান। কিন্তু আমার মতো অসহায় মানুষের কথা কখনো ভেবেছেন? খোঁজ নিয়েছেন, আমরা কীভাবে এত বছর ধরে বেঁচে আছি? কেউ কি নিয়েছে?’ তারপর কান্নার শব্দ। আর কোনো কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। এই নারীর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ মেঘ জমলে যেমন লাগে, ঠিক সেই রকম বিষণ্ন-নিঃস্ব মনে হলো নিজেকে।

একটু পরে মনে হলো, ফোনটা পেয়ে ভালোই হয়েছে। অনেক দিন ধরে আমি এই নারীকেই যেন খুঁজছি। কিন্তু ঠিকানা না জানায় হদিস করতে পারিনি। এবার অন্তত ফোন নম্বরটা পাওয়া গেল। দুই দিন পরে ফোন দিলাম, ধরল তার কিশোরী মেয়ে। মাকে চাইতেই ধরিয়ে দিল। পরিচয় দিয়ে বললাম, কাল আসতে চাই। প্রথমে একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বাড়ির ঠিকানা দিলেন।

পুরান ঢাকার বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি। সেই গলি ধরে লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাড়িটি খুঁজতে ঘাম ছুটে গেল। বাড়ি না বলে একে বাসা বলাই ভালো। জরাজীর্ণ বাড়ির একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি আর দুই সন্তান। দুই হাজার টাকার এই ভাড়াটের খোঁজ আশপাশের বাসিন্দারাও ঠিকমতো জানেন না। সারাটা জীবন নীরব থাকা এই নারী আমাকে কোনো কথা বলতে চাইছিলেন না। পাশে বসা ছেলে মায়ের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, মা, বলো, সবাই জানুক। এর পরই মুখ খুললেন নিলুফার।

তার আগে বলি নিলুফারের বাড়িতে যাওয়ার হেতু। ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আমার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর হইচই পড়ে গিয়েছিল। সেটি প্রকাশের পর রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছিলেন সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তখনকার আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদকে এর জন্য তিনবার সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছিল।

সেই খবরে বলা হয়েছিল, জোড়া খুনের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সুইডেনপ্রবাসী বিএনপি নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ জিন্টু ২৩ বছর পলাতক থাকার পর ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর আত্মসমর্পণের পর ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি অতি দ্রুততার সঙ্গে ফাঁসির সাজা মওকুফ করে দেন। সেদিনই তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। জিন্টু ও তাঁর সহযোগীদের হাতে যাঁরা খুন হয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন নিলুফার ইয়াসমিন লিলি নামের এই নারীর স্বামী ফিরোজ আল মামুন।

নিলুফারের বাড়িতে আলাদা করে বসার কোনো বন্দোবস্ত নেই। কথা হচ্ছিল তাঁর চৌকিতে বসে। সেটির এক পাশে আমি, অন্য পাশে তিনি, তাঁর ছেলে সুমন ও মেয়ে সোমা। তিনি আমাকে বললেন, ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি ডেমরা এলাকায় তাঁর স্বামী ফিরোজ আল মামুন খুন হন। তাঁর সঙ্গে খুন হয়েছিলেন আবদুল খালেক রানা নামের এক ব্যবসায়ী। সে সময় এক হোটেল কর্মচারী তাঁকে জানিয়েছিলেন, অভিসার সিনেমা হলের পাশের একটি হোটেলে জিন্টু ও মানিকের সঙ্গে ফিরোজকেও দেখা গিয়েছিল। তখন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

সেই ঘটনায় মহিউদ্দিন জিন্টু, গালকাটা কামাল, শহীদ হোসেন ও আবুল কাসেম মানিকের ফাঁসির আদেশ হয়। পরে এরশাদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে আবুল কাশেম মানিকের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে দেন। তবে জিন্টু ও শহীদ পলাতক ছিলেন।

নিলুফার বললেন, ফিরোজ আল মামুন যখন খুন হন, তখন তাঁর কোলে দুই মাস আর দেড় বছর বয়সী দুই শিশু। কোথাও কোনো সহায় নেই। দিশেহারা হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। থানায় মামলা করেন। কিন্তু মূল আসামির নামই বাদ রাখা হয়। মামলার শুনানির সময় তিনি সামরিক আদালতে স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে জিন্টুর নাম বলেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বস্তি পান যখন জিন্টুসহ হত্যাকারীদের ফাঁসির আদেশ হয়।

স্বামীর হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে—এই স্বস্তি নিয়ে নিলুফার এবার ঝাঁপিয়ে পড়েন সন্তানদের গড়ে তুলতে। সংসারের হাল ধরতে শ্যামলীর একটি এতিমখানায় শিশু লালন-পালনের কাজ নেন। নিলুফারের সেই ছেলে-মেয়ে এরপর বড় হয়। ক্লান্তিকর অতীত পেরিয়ে যখন কিছুটা সুখের মুখ দেখতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আবার তাঁর জীবনে ঝড় বয়ে যায়। মহিউদ্দিন জিন্টুর ফাঁসির দণ্ড রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দিয়েছেন—এ কথা শুনে হতাশায় ভেঙে পড়েন নিলুফার। তবে ঘটনাটি নিয়ে চারদিকে এত আলোচনা হলেও পরিবারটি কিছুই জানতে পারেনি। তাঁর ছেলে সুমন একটি বাড়িতে টিউশনি করতে গিয়ে পুরোনো পত্রিকা পড়ে সব জানতে পারেন। এরপর বাড়ি ফিরে মাকে জানান।

নিলুফার বললেন, ফিরোজ নিহত হওয়ার সময় মেয়ে সোমার বয়স ছিল দেড় বছর আর সুমনের দুই মাস। বাবার কোনো স্মৃতিই তাদের মনে নেই। সুমন ছবি আঁকতে পারে। অসহায় পরিবারটির খরচ জোগাড় হচ্ছিল ভালো আঁকিয়ে সুমনের টিউশনির টাকায়।

নিলুফার বলেছিলেন, লাশ পাওয়ার পর সেই হোটেলের কর্মচারী আবার তাঁর কাছে এসে খুনের ঘটনা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জিন্টু ও মানিকের সঙ্গে সন্ত্রাসী গালকাটা কামাল তাঁর হোটেলে বসে খুনের ব্যাপারে আলাপ করেছেন। টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসী গালকাটা কামাল ফিরোজকে খুন করেন। লাশ দাফনের পর তিনি নিজে ডেমরা থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে ঘটনার বিবরণ দেন। পুলিশ মামলার বিবরণ লিখে তাঁকে সই করতে বললে তিনি সই করেন। এরপর চার্জশিট দেওয়ার সময় জিন্টুর নাম বাদ দেওয়া হয়।

হত্যা মামলাটির বিচার হয় তৎকালীন সামরিক আদালত-১-এ। আদালত নিলুফারের জবানবন্দি নেওয়ার পর মামলাটি আবার তদন্তের নির্দেশ দেন। বিচার শেষে মামলার রায় ঘোষণা হয় ১৯৮২ সালের ২০ জুলাই। রায়ে তখনকার শীর্ষ সন্ত্রাসী গালকাটা কামাল, তাঁর দুই সহযোগী শহীদ হোসেন ও আবুল কাসেম মানিকের সঙ্গে মহিউদ্দিন জিন্টুরও ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ফাঁসি কার্যকর করার আগে নিলুফারের সামনে কামালকে হাজির করা হয়েছিল। তখন কামাল তাঁর কাছে মাফ চেয়ে বলেছিলেন, ‘ফিরোজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা ছিল না। টাকার বিনিময়ে আমি তাঁকে খুন করেছি।’ কারা টাকা দিয়েছিল, আপনি তা জানতে চেয়েছিলেন? জবাবে নিলুফার বললেন, ‘হ্যাঁ, কামাল বলেছিল, মানিক ও জিন্টু তাঁকে খুন করার জন্য টাকা দিয়ে ভাড়া করেছিল।’

এই খুনের ১০-১২ দিন পর সে সময়ের এক মন্ত্রীও তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। খুনের সঙ্গে জিন্টু ও মানিক জড়িত ছিলেন বলে জানালে তিনি ‘দেখবেন’ বলে চলে যান। সেই আশ্বাসে ২৩ বছর কাটে। কিন্তু কেউ কিছুই করেননি।

স্বামীকে হারানোর পর দুই সন্তান নিয়ে নিলুফার বিপাকে পড়েন। বনগ্রামের বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে যান মায়ের কাছে। প্রাণে-মানে বাঁচতে এতিমখানায় কাজ নেন। ২০ বছর সেখানেই শিশু লালন-পালনের কাজ করেন। মাত্র দুই বছর আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় সেই কাজ ছেড়ে দেন।

নিলুফার বলেছিলেন, স্বামীর খুনির সাজা মওকুফের কথা শুনে তিনি খুব কেঁদেছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছেলেমেয়েরাও। একবার তাঁরা একসঙ্গে আত্মহত্যা করবেন বলেও স্থির করেছিলেন। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, তাঁদের মতো গরিব মানুষের কোনো কিছুতেই কোনো আক্ষেপ নেই, কারও কাছে কিছু চাওয়ার নেই। জীবনে তাঁদের কোনো প্রাপ্তি নেই—সবই হারানোর। তাহলে শুধু শুধু কেন মরতে যাবেন। এরপর সিদ্ধান্ত বদল করেন।

নিলুফারের সঙ্গে কথা শেষ করে ফিরছি। রাস্তায় চলছি, কিন্তু ঘোর কাটছে না। অতিসাধারণ এক নারীর এই জীবনবোধ আমাকে হতবাক করেছে। মনে হয়েছিল, এই নারী সাধারণ কেউ নন, তিনি বড় কোনো দার্শনিক আর আমি তাঁর শিক্ষার্থীমাত্র।

আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

খুনের পর মোবাইল, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট, ‘গৃহকর্মী আয়েশা’র পরিচয় মেলেনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫৭
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে খুন করার পর কথিক গৃহকর্মী আয়েশা ওই বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, বেশ কিছু স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করেন। এ ঘটনায় গতকাল সোমবার রাতে মোহাম্মদপুর থানায় করা হত্যা মামলার এজাহারে এই দাবি করা হয়েছে। তবে আয়েশা নামে পরিচয় দেওয়া ওই তরুণীর প্রকৃত পরিচয় মেলেনি এখনো।

স্ত্রী লায়লা আফরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫) হত্যার ঘটনায় গতকাল মামলাটি করেন নাটোরের স্থায়ী বাসিন্দা আ জ ম আজিজুল ইসলাম। মামলায় কথিত গৃহকর্মী মোছা. আয়েশাকে (২০) একমাত্র আসামি করা হয়েছে। তবে এজাহারে তাঁর বাবার নাম ও ঠিকানায় ‘অজ্ঞাত’ লেখা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে আজকের পত্রিকাকে মামলার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রকিবুজ্জামান তালুকদার। গতকাল সকাল ৭টা ৫১ মিনিট থেকে ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এজাহারে বাদী আজিজুল লিখেছেন, তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। মোহাম্মদপুরে পরিবার নিয়ে থাকেন। চার দিন আগে উল্লিখিত আসামি তাঁর বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। গতকাল সকাল ৭টার দিকে তিনি (আজিজুল) তাঁর কর্মস্থল উত্তরায় চলে যান। কর্মস্থলে থাকাকালে তিনি তাঁর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

পরে তিনি বেলা ১১টার দিকে বাসায় আসেন। এসে দেখতে পান, তাঁর স্ত্রীর গলাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটা। স্ত্রী রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন আর মেয়ের গলার নিচে ডান পাশে কাটা। মেয়ে গুরুতর অবস্থায় বাসার প্রধান ফটকে পড়ে আছে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে তিনি দ্রুত তাকে উদ্ধার করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী আশিকের মাধ্যমে মেয়েকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

মামলায় আজিজুল আরও লিখেছেন, তিনি বাসার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করেন। এতে তিনি দেখতে পান, আসামি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটের সময় কাজ করার জন্য বাসায় আসেন। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের সময় আসামি তাঁর (বাদী) মেয়ের স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ অন্যান্য মূলবান সামগ্রী নিয়ে যান আসামি।

মামলায় বাদী লিখেছেন, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, অজ্ঞাত কারণে আসামি তাঁর (বাদী) স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি বা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করেন।

মা-মেয়ে হত্যার আসামিকে শনাক্ত করা যায়নি। মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ জানায়, গৃহকর্মীর পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত