ইসলামী ব্যাংকে লুট
ওমর ফারুক, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ ইউনিটেক্স। ১৯৮০ সালে ব্যবসা শুরু করেন গ্রুপটির কর্ণধার মো. হানিফ চৌধুরী। প্রথমে তৈরি পোশাক, পরে টেক্সটাইল, স্পিনিং, গ্যাস, সিনথেটিক খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় ইউনিটেক্স গ্রুপ। ব্যবসা পরিচালনা করতে মো. হানিফ চৌধুরী প্রয়োজনীয় ঋণও নিয়েছিলেন কয়েকটি ব্যাংক থেকে।
তবে ব্যাংকিং খাতে ইউনিটেক্সের আধিপত্য শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে; হানিফ চৌধুরীর ছেলে বেলাল আহমেদের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের বিয়ের পর।
ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি শত শত কোটি টাকা ঋণ নিতে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের মালিকানা প্রতিষ্ঠার পর ব্যাংকটি থেকে ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা লোপাট করেছে গ্রুপটি। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংক থেকে ৩২৬ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ৪৭ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪০ কোটি মিলিয়ে গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম পরিবারের মতো গা ঢাকা দিয়েছেন ইউনিটেক্সের কর্ণধারেরাও।
এরপর খারাপ হতে শুরু করে গ্রুপটির ঋণমান। ইতিমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া ঋণের ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এমনকি ঋণের টাকা উদ্ধারে গ্রুপটির বন্ধক রাখা স্থাপনাসহ সম্পত্তি নিলামে তুলেছে ব্যাংকটি। যদিও এই সম্পত্তি (৬২ দশমিক ৭৫ একর) বিক্রি করে ঋণের ২ শতাংশ (৮৩ কোটি) টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে বেলাল আহমেদ ইসলামী ব্যাংক থেকে এই ঋণ হাতিয়ে নেন। ঋণ বিতরণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ঋণের তুলনায় বন্ধকি সম্পত্তি খুবই অপ্রতুল। তাই ঋণের টাকা আদায়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংকের ঋণের মধ্যে ইউনিটেক্স স্টিলের নামে ৮১৪ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে ব্যাংকটির পাহাড়তলী শাখা থেকে। শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ইউনিটেক্স স্টিলের ঋণ অনুমোদন হয় ২০২২ সালে। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৩৮৮ কোটি ৫০ লাখ ফান্ডেড এবং ৩০০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড (যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র) অর্থাৎ ৪২৬ কোটি টাকার দায় তৈরি হয়েছে।
তবে আজকের পত্রিকা'র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৮১৪ কোটি টাকা ঋণ নিলেও ইউনিটেক্স স্টিল এখনো একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির নামে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় ১৮৮০ শতক জমি কেনা হলেও সেখানে কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। ঋণের বিপরীতে ওই জমিগুলোই কোলাটারেল (বন্ধক) দেওয়া হয়েছে ব্যাংকে, যা বিক্রি করে সর্বোচ্চ ২৮ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ ছাড়া বন্ধক রাখা জমিগুলো কেনা হয়েছে ২০২২ সালে। অর্থাৎ কারখানা তৈরি ও জমি কেনার আগেই কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক পাহাড়তলী শাখার ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান সরকার বলেন, ‘কারখানা স্থাপনের আগেই প্রতিষ্ঠানটিতে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঋণের টাকা উদ্ধারে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিলামে তুলেছি। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে।’
ইউনিটেক্স গ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ঋণ নিয়ে জমি কিনেছি। আমাদের এই প্রকল্প চলমান। এখনো শেষ হয়নি। তার মধ্যে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। অর্থায়নের অভাবে চলমান প্রকল্প বন্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠান খেলাপি হওয়ায় আমাদের পুরো গ্রুপের ওপর প্রভাব পড়বে।’
গ্রুপটির বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের নামে ২ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ইউনিটেক্সে এলপি গ্যাসে ২ হাজার ২৩ কোটি, ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিংয়ে ৬০৭ কোটি এবং এবং ইউনিটেক্স গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ২৯৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান তিনটির কোলাটারেল (স্থাপনাসহ জমি) খুবই নগণ্য, যা বিক্রি করে সর্বোচ্চ ৫৫ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, এস আলমের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে প্রথম ঋণ নেয় ইউনিটেক্স। প্রথম দিকে নেওয়া কম্পোজিট স্পিনিং ও এলপি গ্যাসের ঋণটিতে কিছুটা হলেও নিয়মনীতি মানা হয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ের নামে নেওয়া ঋণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।
গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ইতিমধ্যে ২৯৩ কোটি টাকা ঋণ ছাড় হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কারখানার এখনো একতলা নির্মাণ শেষ হয়নি। অথচ কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রজেক্ট ফাইন্যান্স করলেও কারখানা নির্মাণের আগে ফান্ডেড ঋণ ছাড়ের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার বিপরীতে কোলাটারেল মাত্র ৪ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রথম দিকে নেওয়া ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিং ও এলপি গ্যাসে গ্রুপটির চেয়ারম্যান মো. হানিফ চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বেলাল আহমেদের নাম রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি নেওয়া দুই প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স স্টিল ও গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে মালিকানা দেখানো হয়েছে তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে। যদিও এসব ঋণের সরাসরি বেনিফিশিয়ারি হানিফ ও বেলাল। মূলত ঋণের দায় এড়াতে তাঁরা এ কৌশল অবলম্বন করেছেন বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কোম্পানিগুলোতে নাম রয়েছে বেলালের স্ত্রী মাইমুনা খানম (এস আলমের মেয়ে), চাচা আব্দুল আজিজ, ফুফা শহীদুল্লাহ কাইছার, কাজিন সৈয়দ মশিউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ মহিউদ্দিন আহমেদ ও মো. মোহাইমেনুল ইসলাম চৌধুরী।
ইউনিটেক্স গ্রুপের কর্ণধারদের মধ্যে বেলাল আহমেদ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তাঁর স্ত্রী মাইমুনা খানম (এস আলমের মেয়ে) গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
ইউনিটেক্স গ্রুপের ঋণ প্রদানে যে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি তার চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও। ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে দেওয়া ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিং, এলপি গ্যাস এবং গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ের ঋণ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের ঋণ আবেদন, মঞ্জুরি, বিতরণ, লেনদেন, বার্ষিক টার্নওভার, আর্থিক প্রতিবেদন, আয়কর বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। যে বিনিয়োগ ফান্ড ডাইভার্ট করার আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে ঋণ দেওয়া হলেও ইউনিটেক্সের চেয়ারম্যান মো. হানিফ চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ ও পরিচালক মাইমুনা খানমের অনুকূলে দেওয়া ঋণের তথ্য সিআইবিতে রিপোর্ট করা হয়নি।
ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান তিনটির মর্টগেজ করা সহায়ক জামানতে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মূল্যায়ন করা হয়েছে।
কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ১১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে গ্র্যান্ড স্পিনিংকে। এমনকি কারখানা প্রতিষ্ঠার আগেই প্রতিষ্ঠানটিকে ২৯৩ কোটি টাকা ঋণছাড় করেছে ব্যাংক।
ইউনিটেক্স গ্রুপের জিএম (ফাইন্যান্স) মোহাম্মদ মোস্তাক বলেন, ‘৪৫ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে ইউনিটেক্স গ্রুপ। ৫ আগস্টের আগে আমাদের ঋণখেলাপি হওয়ার রেকর্ড নেই। এস আলম পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে আমাদের ওপর চাপ দেওয়া হলে পুরো ইউনিটেক্স গ্রুপই বিপাকে পড়বে। ঝুঁকিতে পড়বে ব্যাংক ও গ্রুপের বিনিয়োগ। কর্মসংস্থান হারাবে কয়েক হাজার লোক, যা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। বিনিয়োগ সুবিধা অব্যাহত রেখে ব্যবসার সুযোগ দেওয়ার জন্য বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি।’
ইউনিটেক্স গ্রুপের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউনিগ্যাস’ নামে বাজারজাত হওয়া ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় দুটি প্ল্যান্ট রয়েছে। প্ল্যান্ট দুটির সর্বোচ্চ সক্ষমতা ৫ হাজার ১৫০ টন। প্ল্যান্ট দুটি নির্মাণসহ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫০০ কোটি টাকা ঋণ প্রয়োজন। কিন্তু কোম্পানিটির নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে গ্রুপটি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম।
ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে ও তাঁদের স্বজনেরা মিলে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে এস আলম পরিবার ও তাঁর স্বজনেরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
আরও খবর পড়ুন:
চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ ইউনিটেক্স। ১৯৮০ সালে ব্যবসা শুরু করেন গ্রুপটির কর্ণধার মো. হানিফ চৌধুরী। প্রথমে তৈরি পোশাক, পরে টেক্সটাইল, স্পিনিং, গ্যাস, সিনথেটিক খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় ইউনিটেক্স গ্রুপ। ব্যবসা পরিচালনা করতে মো. হানিফ চৌধুরী প্রয়োজনীয় ঋণও নিয়েছিলেন কয়েকটি ব্যাংক থেকে।
তবে ব্যাংকিং খাতে ইউনিটেক্সের আধিপত্য শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে; হানিফ চৌধুরীর ছেলে বেলাল আহমেদের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের বিয়ের পর।
ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি শত শত কোটি টাকা ঋণ নিতে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের মালিকানা প্রতিষ্ঠার পর ব্যাংকটি থেকে ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা লোপাট করেছে গ্রুপটি। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংক থেকে ৩২৬ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ৪৭ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪০ কোটি মিলিয়ে গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম পরিবারের মতো গা ঢাকা দিয়েছেন ইউনিটেক্সের কর্ণধারেরাও।
এরপর খারাপ হতে শুরু করে গ্রুপটির ঋণমান। ইতিমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া ঋণের ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এমনকি ঋণের টাকা উদ্ধারে গ্রুপটির বন্ধক রাখা স্থাপনাসহ সম্পত্তি নিলামে তুলেছে ব্যাংকটি। যদিও এই সম্পত্তি (৬২ দশমিক ৭৫ একর) বিক্রি করে ঋণের ২ শতাংশ (৮৩ কোটি) টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে বেলাল আহমেদ ইসলামী ব্যাংক থেকে এই ঋণ হাতিয়ে নেন। ঋণ বিতরণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ঋণের তুলনায় বন্ধকি সম্পত্তি খুবই অপ্রতুল। তাই ঋণের টাকা আদায়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংকের ঋণের মধ্যে ইউনিটেক্স স্টিলের নামে ৮১৪ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে ব্যাংকটির পাহাড়তলী শাখা থেকে। শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ইউনিটেক্স স্টিলের ঋণ অনুমোদন হয় ২০২২ সালে। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৩৮৮ কোটি ৫০ লাখ ফান্ডেড এবং ৩০০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড (যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র) অর্থাৎ ৪২৬ কোটি টাকার দায় তৈরি হয়েছে।
তবে আজকের পত্রিকা'র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৮১৪ কোটি টাকা ঋণ নিলেও ইউনিটেক্স স্টিল এখনো একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির নামে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় ১৮৮০ শতক জমি কেনা হলেও সেখানে কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। ঋণের বিপরীতে ওই জমিগুলোই কোলাটারেল (বন্ধক) দেওয়া হয়েছে ব্যাংকে, যা বিক্রি করে সর্বোচ্চ ২৮ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ ছাড়া বন্ধক রাখা জমিগুলো কেনা হয়েছে ২০২২ সালে। অর্থাৎ কারখানা তৈরি ও জমি কেনার আগেই কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক পাহাড়তলী শাখার ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান সরকার বলেন, ‘কারখানা স্থাপনের আগেই প্রতিষ্ঠানটিতে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঋণের টাকা উদ্ধারে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিলামে তুলেছি। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে।’
ইউনিটেক্স গ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ঋণ নিয়ে জমি কিনেছি। আমাদের এই প্রকল্প চলমান। এখনো শেষ হয়নি। তার মধ্যে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। অর্থায়নের অভাবে চলমান প্রকল্প বন্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠান খেলাপি হওয়ায় আমাদের পুরো গ্রুপের ওপর প্রভাব পড়বে।’
গ্রুপটির বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের নামে ২ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ইউনিটেক্সে এলপি গ্যাসে ২ হাজার ২৩ কোটি, ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিংয়ে ৬০৭ কোটি এবং এবং ইউনিটেক্স গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ২৯৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান তিনটির কোলাটারেল (স্থাপনাসহ জমি) খুবই নগণ্য, যা বিক্রি করে সর্বোচ্চ ৫৫ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, এস আলমের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে প্রথম ঋণ নেয় ইউনিটেক্স। প্রথম দিকে নেওয়া কম্পোজিট স্পিনিং ও এলপি গ্যাসের ঋণটিতে কিছুটা হলেও নিয়মনীতি মানা হয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ের নামে নেওয়া ঋণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।
গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ইতিমধ্যে ২৯৩ কোটি টাকা ঋণ ছাড় হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কারখানার এখনো একতলা নির্মাণ শেষ হয়নি। অথচ কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রজেক্ট ফাইন্যান্স করলেও কারখানা নির্মাণের আগে ফান্ডেড ঋণ ছাড়ের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার বিপরীতে কোলাটারেল মাত্র ৪ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রথম দিকে নেওয়া ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিং ও এলপি গ্যাসে গ্রুপটির চেয়ারম্যান মো. হানিফ চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বেলাল আহমেদের নাম রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি নেওয়া দুই প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স স্টিল ও গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে মালিকানা দেখানো হয়েছে তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে। যদিও এসব ঋণের সরাসরি বেনিফিশিয়ারি হানিফ ও বেলাল। মূলত ঋণের দায় এড়াতে তাঁরা এ কৌশল অবলম্বন করেছেন বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কোম্পানিগুলোতে নাম রয়েছে বেলালের স্ত্রী মাইমুনা খানম (এস আলমের মেয়ে), চাচা আব্দুল আজিজ, ফুফা শহীদুল্লাহ কাইছার, কাজিন সৈয়দ মশিউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ মহিউদ্দিন আহমেদ ও মো. মোহাইমেনুল ইসলাম চৌধুরী।
ইউনিটেক্স গ্রুপের কর্ণধারদের মধ্যে বেলাল আহমেদ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তাঁর স্ত্রী মাইমুনা খানম (এস আলমের মেয়ে) গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
ইউনিটেক্স গ্রুপের ঋণ প্রদানে যে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি তার চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও। ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে দেওয়া ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিং, এলপি গ্যাস এবং গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ের ঋণ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের ঋণ আবেদন, মঞ্জুরি, বিতরণ, লেনদেন, বার্ষিক টার্নওভার, আর্থিক প্রতিবেদন, আয়কর বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। যে বিনিয়োগ ফান্ড ডাইভার্ট করার আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে ঋণ দেওয়া হলেও ইউনিটেক্সের চেয়ারম্যান মো. হানিফ চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ ও পরিচালক মাইমুনা খানমের অনুকূলে দেওয়া ঋণের তথ্য সিআইবিতে রিপোর্ট করা হয়নি।
ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান তিনটির মর্টগেজ করা সহায়ক জামানতে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মূল্যায়ন করা হয়েছে।
কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ১১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে গ্র্যান্ড স্পিনিংকে। এমনকি কারখানা প্রতিষ্ঠার আগেই প্রতিষ্ঠানটিকে ২৯৩ কোটি টাকা ঋণছাড় করেছে ব্যাংক।
ইউনিটেক্স গ্রুপের জিএম (ফাইন্যান্স) মোহাম্মদ মোস্তাক বলেন, ‘৪৫ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে ইউনিটেক্স গ্রুপ। ৫ আগস্টের আগে আমাদের ঋণখেলাপি হওয়ার রেকর্ড নেই। এস আলম পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে আমাদের ওপর চাপ দেওয়া হলে পুরো ইউনিটেক্স গ্রুপই বিপাকে পড়বে। ঝুঁকিতে পড়বে ব্যাংক ও গ্রুপের বিনিয়োগ। কর্মসংস্থান হারাবে কয়েক হাজার লোক, যা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। বিনিয়োগ সুবিধা অব্যাহত রেখে ব্যবসার সুযোগ দেওয়ার জন্য বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি।’
ইউনিটেক্স গ্রুপের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউনিগ্যাস’ নামে বাজারজাত হওয়া ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় দুটি প্ল্যান্ট রয়েছে। প্ল্যান্ট দুটির সর্বোচ্চ সক্ষমতা ৫ হাজার ১৫০ টন। প্ল্যান্ট দুটি নির্মাণসহ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫০০ কোটি টাকা ঋণ প্রয়োজন। কিন্তু কোম্পানিটির নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে গ্রুপটি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম।
ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে ও তাঁদের স্বজনেরা মিলে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে এস আলম পরিবার ও তাঁর স্বজনেরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
আরও খবর পড়ুন:
বেনাপোল স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ছে। হ্যান্ডলিংয়ের আগে পণ্য চালান পরীক্ষার নামে এই অতিরিক্ত খরচ চাপ দিচ্ছে। প্রতিটি চালানে ১৫-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। কখনো কখনো রিপোর্ট পেতে সময় লাগছে এক মাসেরও বেশি, আর ওই সময় পণ্য বন্দরে আটকা পড়ে।
২ ঘণ্টা আগে২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘিরে নানা প্রশ্ন আর আলোচনা চলছে। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে কি না, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য দেশ কতটা প্রস্তুত, বিদেশি বাজার ধরে রাখতে কী উদ্যোগ দরকার—এসব নিয়েই মুখোমুখি হলেন অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ী নেতারা।
২ ঘণ্টা আগেএ পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি, অবিলম্বে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। তার মাধ্যমে রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক কার্যক্রম সময়ক্ষেপণ বই কিছু নয় বলে মনে করে ঐক্য পরিষদ।
৫ ঘণ্টা আগেচতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক ‘ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি’। ২০১৩ সালে লাইসেন্স পাওয়া এই ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। এই ঋণের প্রায় ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ হাজার ২২৯ কোটি টাকাই নামে-বেনামে হাতিয়ে নিয়েছে বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলম। ঋণের নামে লুট করা এই টাকা সবচেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে
১ দিন আগে