Ajker Patrika

আটকে থাকা বিমা দাবি: বিমার পাওনা পেতে দিশেহারা গ্রাহক

মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
আটকে থাকা বিমা দাবি: বিমার পাওনা পেতে দিশেহারা গ্রাহক

বছরের পর বছর বিমা কোম্পানির দরজায় ঘুরেও টাকার দেখা পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। একসময় ভবিষ্যতের ভরসা ছিল এই খাত, এখন সেটিই পরিণত হয়েছে আস্থাহীনতার প্রতীকে। দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর কাছে গ্রাহকদের আটকে আছে ৭ হাজার কোটি টাকা, অথচ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি পরিশোধ করছে না।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্যমতে, ৭৫টি জীবন ও সাধারণ বিমা কোম্পানির মধ্যে অনেকে বছরের পর বছর গ্রাহকের দাবি ঝুলিয়ে রেখেছে। বিমা আইন অনুযায়ী মেয়াদপূর্তির ৯০ দিনের মধ্যে দাবি পরিশোধ বাধ্যতামূলক, কিন্তু বাস্তবে সেই নিয়ম কাগজেই সীমাবদ্ধ।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের গ্রাহক নোয়াখালীর গৃহিণী সানজিদা আক্তার তারই এক উদাহরণ। ৩৩ হাজার টাকার দাবির জন্য গত সাত বছরে ১১ বার ঢাকায় এসেছেন তিনি। অফিসে অফিসে ঘুরেও টাকা পাননি, বরং যাতায়াতেই তাঁর খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে সানজিদার মতো আরও লাখো গ্রাহক বছরের পর বছর বিমা কোম্পানিগুলোর কাছে আটকে থাকা টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন।

অর্থ লোপাট, অদক্ষ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট ও অপরিপক্ব বিনিয়োগে জর্জরিত বিমা খাত এখন গভীর আর্থিক সংকটে। গ্রাহক দাবি পরিশোধ না করতে পারায় ব্যবসায়িক আস্থা কমছে, নতুন গ্রাহকও বিমুখ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ স্বীকার করেছেন, ‘লাইফ ও নন-লাইফের বেশ কিছু কোম্পানিতে অর্থ লোপাট হয়েছে। এই কারণে এখন কোম্পানিগুলো অর্থসংকটে ভুগছে এবং গ্রাহকের দাবি মেটাতে পারছে না।’ তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কয়েকটি কোম্পানির জন্য সবাই বিমা খাতকে ঘৃণা করছে। বিমার নাম শুনলেই মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি পাল্টানোর চেষ্টা করছি। যাঁরা টাকা নিয়ে পালিয়েছেন, তাঁদের আইনের আওতায় এনে অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’

বিশ্লেষকদের মতে, বিমা খাতের দুরবস্থার পেছনে রয়েছে চারটি মূল কারণ—অর্থ লোপাট, ব্যর্থ বিনিয়োগ, নীতিগত অবহেলা ও ইচ্ছাকৃত অর্থ আটকে রাখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মাইন উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ব্যাংক খাতের মতোই বিমা খাতে আর্থিক লোপাটের বড় জায়গা তৈরি হয়েছে। অদক্ষ বিনিয়োগ ও মেরে খাওয়ার প্রবণতা এ খাতকে ধ্বংস করছে।’

আইডিআরএর তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ৮২টি বিমা কোম্পানি রয়েছে; যার ৩৬টি জীবন বিমা ও ৪৬টি সাধারণ বিমা। এর মধ্যে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে দাবি পরিশোধ করেছে মাত্র ৩৫ শতাংশ, আর সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রায় ৯২ শতাংশ দাবি এখনো ঝুলে আছে।

সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে সরকারি সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি), গ্রাহক পাওনা ২ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। এরপর গ্রীন ডেল্টার ২৭০ কোটি, প্রগতির ১৬৪ কোটি, রিলায়েয়েন্সের ১০১ কোটি ও পিপলস ইনস্যুরেন্সের ৮১ কোটি। এভাবে মোট ৪৬টি নন-লাইফ কোম্পানির কাছে পাওনা ৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৩০০ কোটি, অর্থাৎ এখনো ৯২ শতাংশ দাবি অনিষ্পন্ন।

নন-লাইফ বিমার এই অবস্থার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালিকদের অর্থ আটকে রাখার মানসিকতা, গ্রাহকের অসম্পূর্ণ কাগজপত্র, সার্ভে রিপোর্টে বিলম্ব, এসবিসি থেকে পুনর্বিমার অর্থ ফেরত না পাওয়া এবং বিনিয়োগের ভুল সিদ্ধান্ত—সবকিছু মিলিয়ে এই সংকট তৈরি হয়েছে।

এক বিমা কোম্পানির সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নন লাইফ বিমায় বছরের শেষে হিসাব বন্ধ হয়ে যায়, মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এরপর বড় কোনো দাবি এলে সেটি পরিশোধের অর্থ থাকে না।’

অন্যদিকে, দেশের ৩৬টি জীবন বিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের দাবি উঠেছে ৫ হাজার ৫৭৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যার মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে বকেয়া রয়ে গেছে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যার পুরোটাই ২৯ বিমা কোম্পানির।

গ্রাহকদের টাকা না দেওয়ার শীর্ষে রয়েছে ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স, যার কাছে পাওনা ২ হাজার ৭৪২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। দ্বিতীয় স্থানে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, ২৪৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এরপর রয়েছে প্রগ্রেসিভ লাইফের ১৫৫ কোটি, মেটলাইফ বাংলাদেশের ৮৪ কোটি ও বায়রা লাইফের ৭৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের (বিআইএফ) জয়েন্ট সেক্রেটারি এস এম নূরুজ্জামান বলেন, ‘খারাপ বিনিয়োগ ও মালিকদের দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের দাবি সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। অনেক কোম্পানি দুর্বল ব্যাংক ও লিজিং প্রতিষ্ঠানে অর্থ ঢেলেছে, এখন তা উদ্ধার সম্ভব নয়। আবাসন খাতেও বিনিয়োগ করা হয়েছিল, কিন্তু জমি বিক্রি করেও সমপরিমাণ অর্থ মিলছে না।’

বিমা বিশ্লেষক এস এম জিয়াউল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘লাইসেন্স টিকিয়ে রাখতে হলেও বিমা দাবি দ্রুত পরিশোধ করা দরকার। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা এবং সদিচ্ছার অভাবে কোম্পানিগুলো দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। আইডিআরএ কঠোর হলে কেউ দাবি পরিশোধ না করে পারত না।’

এ অবস্থায় আইডিআরএ বলছে, তারা খাতের অস্থিরতা দূর করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ১৫টি বিমা কোম্পানির বিশেষ অডিট শুরু হয়েছে। অডিটে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—কেন তারা সময়মতো দাবি মেটাতে পারছে না এবং কীভাবে বকেয়া পরিশোধ করা যায়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএর চেয়ারম্যান আসলাম আলম বলেন, ‘বেশ কিছু কোম্পানি নিয়ম মানছে না, দাবি সময়মতো দিচ্ছে না। এতে খাতে ভয়াবহ আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বিমা খাতে স্বস্তি ফিরবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই জাতীয় সনদ: গণভোটের সময়ে অনড় জামায়াত-এনসিপি

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব এহসানুল হক

লন্ডনে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে দেখা করে চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছিলেন রোজিনা

গাজায় অবস্থান পুনরুদ্ধার করছে হামাস, ইসরায়েলপন্থীদের দিচ্ছে শাস্তি

সীমা লঙ্ঘনকারীরা বিচারের মুখোমুখি হোক—সেনা কর্মকর্তাদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রসঙ্গে বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত