Ajker Patrika

পুঁজিবাজারের কারসাজি: জরিমানার দণ্ডে আদায় শূন্য

আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা
আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০১: ৩৭
পুঁজিবাজারের কারসাজি: জরিমানার দণ্ডে আদায় শূন্য

দেশের পুঁজিবাজার ছিল একসময় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় আর লাভের সোনার খনি। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে সেই বাজার পরিণত হয় লুটপাট আর কারসাজির আখড়ায়। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা ভরেছেন নিজেদের পকেট, আর পথে বসেছেন লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী।

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর নতুন প্রশাসন বাজারে শুদ্ধি অভিযানে নামে। উদ্দেশ্য ছিল স্বচ্ছতা ফেরানো। এর অংশ হিসেবে অতীতের কারসাজি ও অনিয়মে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রেকর্ড পরিমাণ জরিমানা করা হয়। জরিমানার অঙ্ক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, এক বছর কেটে গেলেও সেই জরিমানার একটি টাকাও আদায় হয়নি।

জরিমানার হিসাব

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্র বলছে, গত এক বছরে বেক্সিমকো, আবুল খায়ের হিরু পরিবার এমনকি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ অনেককে শেয়ারবাজার কারসাজির দায়ে জরিমানা করা হয়েছে। এভাবে ৫০ ব্যক্তি, ৩২ প্রতিষ্ঠানসহ ৮২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৩৮ কোটি ৬৫ টাকা জরিমানা করা হয়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

সবচেয়ে আলোচিত নাম বেক্সিমকো লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির চার কর্মকর্তা ও পাঁচ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪২৮ কোটি টাকার রেকর্ড জরিমানা করে বিএসইসি

হিরু-সাদিয়া পরিবারকে জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। হিরুর সঙ্গে শেয়ার কারসাজিতে নাম জড়ায় জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের। এই জুটি এক ঘটনায় ৩১ কোটি টাকার বেশি জরিমানা দণ্ড পেয়েছেন, আরও কয়েকটি ঘটনায় আলাদা জরিমানাও হয়েছে।

পুঁজিবাজারে-কারসাজি

এ ছাড়া সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা ও সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজিতে ১৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১৯০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। বাংলাদেশ ফাইন্যান্স, জেনারেল ইনস্যুরেন্স ও আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের শেয়ার কারসাজিতে ১৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৩৪ কোটি টাকার শাস্তি দেওয়া হয়। এভাবে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে জরিমানার নোটিশ দেওয়া হয়। তাঁরা জরিমানার নোটিশ হাতে পেলেও এখন পর্যন্ত সেই অর্থ পরিশোধ করেননি।

কেন আদায় হচ্ছে না

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম আজকের পত্রিকা'কে বলেন, জরিমানা হলে সঙ্গে সঙ্গে তা আদায় হয়ে যাবে, এমন কোনো বিধান নেই। জরিমানা ঘোষণার পর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ৯০ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারেন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে তা রিভিউ করার সুযোগ পান। চাইলে মাত্র ১৫ শতাংশ জরিমানা জমা দিয়ে তাঁরা উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন। তখন কোর্টের চূড়ান্ত রায় না আসা পর্যন্ত কোনো জরিমানা আদায় করা যায় না। আবার কেউ আবেদন না করলেও নির্দিষ্ট সময় পার হলে কমিশন সার্টিফিকেট মামলা করে থাকে। এরপর আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাজির করতে ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন। এই প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় বলে জানান তিনি।

বিনিয়োগকারীর আস্থায় চিড়

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে শুধু জরিমানা করা যথেষ্ট নয়, এটি আদায় হওয়া জরুরি। কিন্তু আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, জটিল প্রক্রিয়া আর কঠোর প্রয়োগের অভাবে বিনিয়োগকারীরা বারবার হতাশ হচ্ছেন।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক আল-আমিন মনে করেন, বিলম্ব হলেও আদালতের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত জরিমানা আদায় সম্ভব। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নেগোসিয়েশন দরকার। সমন্বিত উদ্যোগে যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত আসে, মানুষ বুঝবে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশ বের হয়ে আসছে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম মনে করেন, এত বড় অঙ্কের জরিমানা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা দেখা দরকার। তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে আদালতে যাওয়ার। তাই সমঝোতা বা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলো মীমাংসা করা ভালো। প্রয়োজনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআরের ব্যবস্থাও কাজে লাগতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত