Ajker Patrika

ট্যাক্স দিয়ে সেবা না পেলে লোকজন তো গোস্সা করবেই: অর্থ উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ০৮
বিএসইসি ও ডিএসই আয়োজিত সেমিনারে অর্থ উপদেষ্টা। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিএসইসি ও ডিএসই আয়োজিত সেমিনারে অর্থ উপদেষ্টা। ছবি: আজকের পত্রিকা

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘বাইরের দেশে বেশি ট্যাক্স দিতে হলেও সরকারের পক্ষ থেকে ভালো সেবা পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ট্যাক্স দেয়, কিন্তু সেবা পায় না। তাহলে লোকজন তো একটু গোস্সা করবেই।’

আজ সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ‍্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের বন্ড ও সুকুক বাজার উন্মোচন: রাজস্ব স্থিতি, অবকাঠামো বাস্তবায়ন ও ইসলামি মানি মার্কেট উন্নয়ন’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা।

এ সময় অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ট্যাক্স দেয়, সেবা পায় না। লোকজন তো একটু গোস্সা করবেই। ট্যাক্স দিলাম আর সেবা পেলাম না। সে জন্য প্রায়ই এনবিআর সদস্যদের বলি, একটু সেবা দেন। সেবা ভালো দিলে আমরা ট্যাক্স ফিটাও বেশি দিতে পারি। সেবা দেবেন না, দশবার ঘোরাবেন, আপনি ফিও বেশি চাইবেন, এটা তো সম্ভব নয়।’

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘ট্যাক্স কমানোর কথা বলে। ট্যাক্স কমাতে কমাতে এমন অবস্থা—আমরা হয়তো বেতন-ভাতাও পাব না। সবাই বলে ট্যাক্স কমিয়ে দেন। ট্যাক্সই দিতে চাই না। আমরা শিক্ষকদের দোষ দিই, পড়াচ্ছে না। এই মাইনে দিয়ে কী পড়াবে? আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ব্রাজিলে ২৬ শতাংশ ট্যাক্স জিডিপি রেশিও। ওরা ট্যাক্স দেয়, সেবা পায়।’

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘ট্যাক্স, নন-ট্যাক্স রেভিনিউ আমাদের অনেক লো। আমাদের দেশে প্রাইভেট সেক্টরের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের চাহিদা অনেক বেশি। বড় বড় প্রজেক্ট করতে বলেন। এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থায়ন করতে পারছি না। আমরা বলি, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। তারপর শিক্ষার কথা বলেন। টাকা কোথায়?’

উপদেষ্টা জনগণ ও সরকারের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, মানুষকে মনে রাখতে হবে যে, তারা কর প্রদান করে বিনিময়ে সেবা পাচ্ছে। এটাই ভালো শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত পরীক্ষা।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে সমস্যা হলো অর্থায়নের অভাব। আমরা যেখানে বসে থাকি, সরকারি লোকজন মনে করে, সবকিছু দিয়ে দেওয়া যাবে। প্রতিদিন বলে এই দেন, সেই দেন। অর্থের যতটা সামর্থ্য, সেটা আমরা পাচ্ছি না।’

উপদেষ্টা বলেন, বড় অবকাঠামো প্রকল্প যেমন এমআরটি (মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট) ব্যবস্থায় সিকিউরিটাইজেশন প্রয়োজন, যেগুলোর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ দরকার।

অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, গ্র্যাচুইটি ও পেনশন ফান্ড বিনিয়োগে আইনি বাধা ও সরকারের দায়বদ্ধতার কারণে তা ব্যবহার করা কঠিন।

অর্থ উপদেষ্টা বিমা খাতের দুর্বলতার কথাও তুলে ধরেন এবং একে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা বলে আখ্যায়িত করে বলেন, এর জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, একটি গতিশীল আর্থিক খাতে শুধু ব্যাংক নয়, বরং শক্তিশালী পুঁজিবাজার, বিমা খাত এবং বিশেষ ট্যাক্স ইনস্ট্রুমেন্টকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

পুঁজিবাজার থেকে সব সময় মুনাফা আসবে—এমন ধারণা ভুল বলে জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এটিকে যদি কেউ নিয়মিত আয়ের স্থায়ী উৎস মনে করে, তবে তা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। মূলধন বাজারে যেমন মুনাফার সুযোগ আছে, তেমনি ক্ষতির ঝুঁকিও রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের সচেতন হতে হবে যে শেয়ার ও বন্ড কেনা মানে কখনো কখনো ক্ষতিও ভাগ করে নেওয়া।

অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করা এবং সুকুক বন্ড সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন, যেন সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে ব্যাংকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানো যায়।

বিএসইসি ও ডিএসই আয়োজিত সেমিনারে অর্থ উপদেষ্টা। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিএসইসি ও ডিএসই আয়োজিত সেমিনারে অর্থ উপদেষ্টা। ছবি: আজকের পত্রিকা

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাত অতিমাত্রায় ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে বেসরকারি ও সরকারি খাতের উভয় পক্ষই ঋণ নেয়, প্রায়ই সেই ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যায়। এটাই বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি। ঝুঁকি ভাগাভাগির জন্য একটি কার্যকর পুঁজিবাজার ও বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে বুঝতে হবে—বন্ড, ডিবেঞ্চার ও সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের সঙ্গে ঝুঁকি জড়িত। পুঁজিবাজার কোনো চিরস্থায়ী গ্যারান্টিযুক্ত আয়ের উৎস নয়। শেয়ারবাজারের ছোট বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, বিনিয়োগ করলেই মুনাফা নিশ্চিত, এই বাজারে যে ঝুঁকি আছে, তা তাঁরা মানতে চান না। ছোট বিনিয়োগকারীদের আরও ভালোভাবে শিক্ষিত করতে ডিএসই ও বিএসইসিকে উদ্যোগ নিতে হবে।

সুকুক বন্ডের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এই ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যাংকের ওপর চাপ কমাতে ব্যাপক সম্ভাবনা রাখে, যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের সুকুক আছে, কিন্তু তার প্রায় সবই সরকারি প্রকল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেসরকারি খাতও টুলটি ব্যবহার করে অবকাঠামো ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে অর্থায়ন করতে পারে।’

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ অর্লিন্সের অধ্যাপক এম কবীর হাসান। অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খোন্দকার রাশেদ মাকসুদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত