Ajker Patrika

ক্রিকেটার সরবরাহে খুলনা বিভাগই এগিয়ে

হাবিবুল বাশার
ক্রিকেটার সরবরাহে খুলনা বিভাগই এগিয়ে

এই প্রশ্ন আমি অনেকবারই শুনেছি। জাতীয় পর্যায়ে খুলনা বিভাগ থেকে এত ক্রিকেটার উঠে আসার কারণটা কী? এর পেছনে কোন থিওরি কাজ করছে? খেলোয়াড় সরবরাহে শুধু ছেলেদের ক্রিকেটে নয়, মেয়েদের ক্রিকেটেও খুলনা বিভাগ অনেক এগিয়ে। সম্ভবত ৬০ শতাংশ ক্রিকেটারই খুলনা বিভাগ থেকে এসেছে।

ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খুলনা বিভাগ সফল এক দল হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি কাজ করেছে, আমাদের ড্রেসিংরুম অনেকটা আন্তর্জাতিক দলের ড্রেসিংরুমের মতোই ছিল। প্রায় সবাই তো জাতীয় দলেরই খেলোয়াড়। দেখা গেছে একাদশের ৯-১০ জনই বাংলাদেশ দলের! ড্রেসিংরুমের পরিবেশটাও অন্যরকম ছিল। মাঠের বাইরে হইচই, আনন্দ, আড্ডা—এসব তো ছিলই। আমরা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতাম মাঠের খেলাটা।

জাতীয় লিগে একটা সময় মাত্র ৪০০ টাকা দৈনিক ভাতা (ডিএ) পেতাম। টাকা-পয়সার চেয়ে তখন খুলনা বিভাগীয় দলে খেলাটা অন্যরকম মর্যাদার ব্যাপার ছিল। আমাদের ভেতরে একটা তাড়াই ছিল যে হারা যাবে না! ভাবনায় কাজ করত, অন্য বিভাগের চেয়ে আমরা অনেক ভালো দল। একটা সময় খুলনা দলে সুযোগ পাওয়াও কঠিন ছিল। আমরা তো কখনো কখনো অন্য বিভাগকে খেলোয়াড় ধারও দিয়েছি! ধারে পাঠাতে চাইলে অনেকে আবার যেতে চাইত না! আমাদের দলে অনেক বোলার থাকত। কারও কারও একাদশে ঠিকঠাক সুযোগ মিলত না। তবু তারা অন্য দলে ধারে খেলতে চাইত না। তাদের কাছে খুলনার ড্রেসিংরুম শেয়ার করাটাও অনেক বড় ব্যাপার মনে হতো।
একটা সময় জাতীয় দলে প্রচুর খেলোয়াড় সরবরাহ করেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম বিভাগ। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে খুলনা বিভাগের প্রতিনিধিত্ব বাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে আমাদের সময় থেকে। জাতীয় দলে খেলোয়াড় সরবরাহে গত তিন দশকে খুলনাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থেকেছে।

সাধারণত সেখান থেকে বেশি ক্রিকেটার উঠে আসে, যেখানে প্রচুর খেলা হয়। টুর্নামেন্ট আয়োজন হয়। অনুশীলনের ভালো ব্যবস্থা থাকে। সত্যি বলতে, খুলনা বিভাগে ওরকম আলাদা কিছু হয় না। বিসিবির নির্বাচক হিসেবে আমার সব বিভাগ দেখারই সুযোগ হয়। সব বিভাগ, জেলাতেই কম-বেশি যাওয়া হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে খুলনা বিভাগে আলাদা কিছু হয়, এটা বলার সুযোগ নেই।

খুলনা বিভাগের ক্রিকেট অবকাঠামো কিংবা প্রচুর ক্রিকেট একাডেমি আছে, তাও নয়। তবু কীভাবে যেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ক্রিকেটার এই অঞ্চল থেকে উঠে আসছে। একটা হতে পারে, এই বিভাগের ছেলে-মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ-প্যাশন অন্য বিভাগের চেয়ে বেশি। অন্য বিভাগের ছেলে-মেয়েরা হয়তো অন্য বিষয়ে আগ্রহী থাকতে পারে বেশি। তবে খুলনা বিভাগের ছেলেমেয়েরা একবার খেলাটার সঙ্গে জড়িয়ে গেলে সহজেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে না।

আগেই বলেছি, সুযোগ-সুবিধায় খুলনা খুব একটা এগিয়ে থাকবে না, বরং অন্য অনেক বিভাগ সুযোগ-সুবিধায় খুলনার চেয়ে যথেষ্ট এগিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এ বিভাগের ছেলেমেয়েরা খেলাটা একটু অন্যভাবে নেয়। অন্যভাবে বলতে প্যাশন, কঠোর পরিশ্রম, সিরিয়াসনেস—ক্রিকেটটা অনেকে শুধু শখের বসে খেলে না। এটাকে জীবন-জীবিকা হিসেবেই নিয়ে থাকে।

 একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে খেলোয়াড় তৈরি হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সামনে থাকা কোনো বড় খেলোয়াড়কে দেখে। পাকিস্তানে একটা সময় অনেক ফাস্ট বোলার তৈরি হতো। তাদের সামনে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিসের মতো বড় বড় ফাস্ট বোলার ছিলেন। তাঁদের অনুসরণ করে অনেকে উঠে এসেছে। আমাদের খুলনা বিভাগেও অনুসরণ করার মতো খেলোয়াড়ের কিন্তু অভাব নেই। প্রায় প্রতিটি জেলায় জাতীয় দলে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় আছে। তাদের সামনে আইকন থাকছে, যাকে দেখে তারা ক্রিকেটে জড়িয়ে থাকতে অনুপ্রাণিত হয়েছে।

যদি আমার কুষ্টিয়া জেলায় দেখি, বর্তমান বিসিবির ন্যাশনাল সেট–আপেই তো দুই-তিনজন আছে। আমার সময়ে আমি ছিলাম। ধরুন, কুষ্টিয়া থেকে যদি একজন খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে, এই জেলার আরও ১০০ ক্রিকেটার তার মতো হতে চাইবে। জাতীয় দলে খুলনা বিভাগের প্রায় প্রতিটি জেলার প্রতিনিধিত্ব থাকে। নড়াইলের মাশরাফি বিন মুর্তজা খেলেছে। মাগুরার সাকিব আল হাসান আছে। সাতক্ষীরার মোস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার আছে। খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর—প্রতিটি জেলারই খেলোয়াড় আছে জাতীয় দলে। এসব জেলায় কিন্তু তেমন ক্রিকেটীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। কিন্তু তাদের সামনে ‘আইডল’ বা ‘আইকনের’ অভাব নেই। ছোট জেলায় বড় আইকন আছে তাদের সামনে।

এই আইকনরা আবার অনেকেই বড় খেলোয়াড় হয়ে যাওয়ার পরও এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখে। যেমন এলাকায় টেপ টেনিসে বড় একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন হয়েছে। সময়-সুযোগ পেলে অনেকে সেখানে খেলে আসে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলি। কুষ্টিয়া থেকে যখন কেউ ডেকেছে, সময়-সুযোগ পেলেই খেলে এসেছি। আগে বেশির ভাগ দর্শকই ঢাকায় এসে খেলা দেখতে পারত না। আমরা যখন এলাকায় খেলতে গেছি, চোখের সামনে দেখে হয়তো অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। মাশরাফির কথাই ধরুন, নড়াইলে সে যখন খেলেছে, চোখের সামনে তাকে দেখে অনেক ছেলেই অনুপ্রাণিত হয়েছে।

এই আইকনদের দেখেই একটা সময় ক্রিকেটের প্রতি অনেকে আকৃষ্ট হয়েছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে কি না, সেটি অবশ্য জোর দিয়ে বলতে পারছি না। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, হাতে হাতে ফোন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিসক্রিয়। খেলার চেয়ে এসবের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। পাঁচ-ছয় বছর আগেও দেখেছি মাঠের প্রতি তাদের কী টান, তুমুল আগ্রহ। আগে খুলনা বিভাগে ক্রিকেটের যে চর্চাটা দেখেছি, সেটা ইদানীং কমতে দেখছি।

আগে টেনিস, টেপ টেনিস, ফাইভ স্টার বলে এই টুর্নামেন্ট-ওই টুর্নামেন্ট প্রায় সারা বছরই হতে দেখেছি। এখন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ যত সহজ হচ্ছে, ততই এ ধরনের ক্রিকেট কমে যাচ্ছে। সুযোগ পেলেই সবাই ঢাকায় চলে আসছে। আমাদের সময়ে আগে পাড়া, এলাকা, জেলা পর্যায়ে প্রচুর খেলতে হয়েছে। আর এখন ছেলেরা এলাকায় খুব একটা থাকছে না। দ্রুত ঢাকায় চলে আসছে। নিজেকে গড়ার সময় তো দিতে হবে। আমরা নিজের পাড়া, এলাকা কিংবা জেলায় খেলে এই প্রাথমিক ভিতটা গড়েছি। এটা এখন কমে যাচ্ছে। 

হাবিবুল বাশার 
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

বকশীগঞ্জের ‘বটগাছ’খ্যাত বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ তালুকদারের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ