Ajker Patrika

মানুষ দেখলেই ভয় পায় দুই বছরের আইরিন

সহিবুর রহমান, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
মানুষ দেখলেই ভয় পায় দুই বছরের আইরিন

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের এক গ্রামে এক পরিবারের তিনজনের মরদেহ উদ্ধার হয় গত বৃহস্পতিবার। মৃত স্বামী-স্ত্রী ও এক প্রতিবন্ধী সন্তান ছাড়াও বেঁচে যাওয়া আরও তিন শিশু আছে ওই পরিবারে। এর মধ্যে দুই বছর বয়সী শিশুটি অপরিচিত কাউকে দেখলেই আতঙ্কে কেঁদে উঠছে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার গাদিশাইল গ্রামে সজ্জুল হক (৪৫), তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তার (৩৫) ও তাদের প্রতিবন্ধী সন্তান ইয়াছিনের (১০) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে সকলের ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার রাতে দাফন করা হয়।

এ ঘটনায় শুক্রবার দুটি মামলা করেছে চুনারুঘাট থানা-পুলিশ। একটি ইউডি মামলা এবং অন্যটি হত্যা মামলা।

চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রাশেদুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তিনটি লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে শুক্রবার দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সজ্জুল হকের আত্মহত্যার জন্য একটি অপমৃত্যু মামলা, আরেকটি মামলায় সজ্জুল হককে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে।’

গতকাল শুক্রবার বিকেলে গাদিশাইল গ্রামের সজ্জুল হকের বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠোনে সুরজল ও জেসমিনের বাকি তিন সন্তান, জিহান (৬), শিরিন (৪) ও আইরিন (২) তাদের ছোট খালা রিতা আক্তারের সঙ্গে রয়েছে। তবে অপরিচিত মানুষ দেখেই আইরিন ভয়ে কান্না শুরু করে রিতা আক্তারের কোলে লুকানোর চেষ্টা করে। আবার কোনো সময় বড় ভাই জিহানের কাছেও আশ্রয় নিচ্ছে। ছয় বছর বয়সী জিহানও বাবা-মা হারানো ছোট দুই বোনের অভিভাবক হয়ে উঠেছে।

একটি মাটির ঘরে বেড়া দিয়ে বাস করতেন সজ্জুল হক ও তাঁর ভাই নূরুল হকের পরিবার। মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ সজ্জুল হকের ঘরটি আপাতত তালা দিয়ে বন্ধ। নুরুল হকের জিম্মায় আপাতত ওই ৩ শিশুকে রাখা হয়েছে। তবে ওই বাড়িতে গিয়ে কাউকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়নি। দু-চারজন প্রতিবেশী নারী ছাড়া বাড়ির আঙিনাতেও কাউকে তেমন দেখা যায়নি। সজ্জুল মিয়াকে যে গাছ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, সে জায়গাটি তাদের ঘর থেকে প্রায় ১৫০ গজ দূরেই। 

রিতা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খবর পেয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় আমি আমার বোনের বাড়িতে আসি। এরপর থেকে আমার বোনের তিনটি অবুঝ শিশুকে আমি কোনোরকমে সান্ত্বনা দিয়ে রাখছি। তবে মানুষ দেখলেই ভয় পাচ্ছে আইরিন।’

সজ্জুল হকের বড় ভাই ইজিবাইক চালক নুরুল হক আজকের পত্রিকাকে জানান, তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী জেসমিন আক্তার তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তান ইয়াছিনকে নিয়ে ভিক্ষা করতেন। এটিই ছিল পরিবারটির প্রধান আয়। সজ্জুল মাঝে-মধ্যে বাঁশ-বেতের ঝুড়ি তৈরি করে বিক্রি করতেন। খুবই কষ্ট করে জেসমিন আক্তার সন্তানদের খাবার জোগাড় করতেন।

নুরুল হক বলেন, ‘সজ্জুল ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যে সব সময় ঝগড়া হতো। তাদের ঝগড়া নিয়ে কয়েকবার বিচার-সালিসও হয়েছে। এর আগেও দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল সজ্জুল।’

সজ্জুলের ঘর

স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাদিশাইল গ্রামে গাঁজাসেবী হিসেবে সজ্জুলের পরিচিতি রয়েছে। তবে গ্রামের কারও সঙ্গে তাঁর কোনো সমস্যা বা শত্রুতা ছিল না। এর আগেও দুবার সজ্জুল আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ৩-৪ মাস আগে তাঁকে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তার। সঙ্গে সঙ্গে দড়ি কাটতে গিয়ে বটি ফসকে জেসমিনের গলায় লাগে। এ জন্য কয়েকটি সেলাইও দিতে হয়। প্রায় দুই বছর আগে বাড়ির পাশে লেবুবাগান এলাকার একটি গাছে ফাঁস লাগানোর সময় গ্রামের এক কিশোর তাঁকে দেখতে পায়। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যান সজ্জুল।

মরদেহ উদ্ধারের প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘গাদিশাইল গ্রামের হালিম নামে একজন বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে আমাকে জানান, সজ্জুল হক গাছে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাৎক্ষণিক ইউপি চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবগত করি। তারপর আমি থানাকে বিষয়টি জানাই। আমি ঘটনাস্থলের কাছাকাছি যাওয়ার সময় খবর পাই ঘরের মধ্যে সজ্জুলের প্রতিবন্ধী ছেলেকেও মৃত পাওয়া গেছে। তখন সজ্জুলের স্ত্রী জেসমিনের খোঁজ শুরু হয়। পরে ঘরের ভেতর খোঁজাখুঁজি করে খাটের নিচে জেসমিন আক্তারের মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ এসে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করে।’ 

তিন শিশুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা
সজ্জুল ও জেসমিনের রেখে যাওয়া তিনটি শিশু সন্তান এখন কীভাবে বেড়ে উঠবে, কার কাছে লালিত হবে বিষয়টি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে গতকাল শুক্রবার হবিগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা শিশুদেরকে তাদের চাচা নুরুল হকের জিম্মায় রেখে যান। তবে দরিদ্র চাচা-চাচির পক্ষে তাদের দায়িত্ব বহন করা অনেক কঠিন। এ দিকে জেসমিনের মা-বাবা মেয়ের তিন সন্তানকে তাদের কাছে রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু চাচার তত্ত্বাবধানেই রাখতে আগ্রহী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন পলাশ ও ইউপি সদস্য আব্বাস উদ্দিন। 
 
ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন পলাশ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সজ্জুল একজন নেশাগ্রস্ত মানুষ ছিল। আমার ধারণা হয়তো নেশা করার জন্য টাকা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতো এ জন্যই এই ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ সজ্জুলের স্ত্রী তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলে ইয়াসিনকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় থেকে সাহায্য উঠাইতেন, এবং সাহায্যের টাকাগুলো স্ত্রী জেসমিনের কাছেই থাকত। আপাতত প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমি এই বাচ্চাদের দায়িত্ব নিচ্ছি। আপাতত ৫০ কেজি চাল ও ডাল এবং বাচ্চাদের জন্য কয়েকটি চিপসের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বাসস্থান ও শিশুদের শিক্ষার জন্য সহযোগিতা করা হবে।’ 

সজ্জুল-জেসমিনের পাশে কেউ ছিল না
মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার একদিন পর শুক্রবার গাদিশাইল গ্রামে যান জেসমিন আক্তারের বাবা শামীম মিয়া। গাদিশাইল গ্রামে বড় ভাই নুরুল হক ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য স্বজন ছিল না সজ্জুলেরও। এ ছাড়াও তাঁর কোনো আয় না থাকায় এবং স্ত্রী ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে থাকায় গ্রামের লোকজনও এড়িয়ে চলতেন বলে জানা গেছে। 

স্থানীয়দের অনেকেই বলছে, শুক্রবার সকাল থেকে তিনটি কবর খোঁড়ার জন্য গ্রামের একজন আরেকজনকে দায়িত্ব দিচ্ছিলেন। বিকেল পর্যন্ত শুধু একটি কবর খোঁড়া হয়েছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

‘ঘুষের জন্য’ ৯১টি ফাইল আটকে রাখেন মাউশির ডিডি: দুদক

রাখাইনে মানবিক করিডর কি প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদ হবে, ভারত-চীন কীভাবে দেখবে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত