Ajker Patrika

লুটপাট

হবিগঞ্জে চলছে সিলিকা বালু তোলার মচ্ছব

  • হবিগঞ্জের চার উপজেলার ছড়া ও নদী থেকে দিনদুপুরে বালু লুট।
  • প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘটছে লুটপাট, কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
  • প্রশাসন বলছে, লোকবলের অভাব, পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
সহিবুর রহমান, হবিগঞ্জ 
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৫, ০১: ২৭
ছড়া থেকে অবৈধভাবে তোলা হয়েছে বালু। পাড়ে রাখা বালু ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। সম্প্রতি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার পাইকপাড়া ইউনিয়নে। ছবি: আজকের পত্রিকা
ছড়া থেকে অবৈধভাবে তোলা হয়েছে বালু। পাড়ে রাখা বালু ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। সম্প্রতি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার পাইকপাড়া ইউনিয়নে। ছবি: আজকের পত্রিকা

নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে দেদার তোলা হচ্ছে হবিগঞ্জের সিলিকা বালু। এতে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনীতিকেরা। প্রশাসনের নাকের ডগায় জেলার ৪টি উপজেলার চা-বাগানের ছড়া এবং কয়েকটি নদী থেকে অবাধে সিলিকা বালু উত্তোলন করা হলেও নেই কোনো পদক্ষেপ। উল্টো বালু উত্তোলনের কারণে ধসের ঝুঁকি থাকায় এলাকাছাড়া হচ্ছে পরিবার; নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক।

হবিগঞ্জের মাধবপুর, চুনারুঘাট, বাহুবল ও নবীগঞ্জের একটি অংশের চা-বাগানের ছড়া থেকে তোলা হচ্ছে সিলিকা বালু। এ ছাড়া মাধবপুরের সোনাই নদ, বাহুবলের করাঙ্গী নদী ও চুনারুঘাটের খোয়াই নদ থেকেও অবাধে তোলা হচ্ছে বালু। কোনো অনুমোদন না থাকলেও রাত-দিন চলছে বালু লুটপাট। এ জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে নির্বিচার সিলিকা বালু উত্তোলন করায় পাহাড়-টিলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে এবং আশপাশের রাস্তাঘাট, স্কুল, চা-শ্রমিকদের বসতঘরসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

বালু বিক্রির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক ঘনফুট সিলিকা বালু বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। প্রতিটি ট্রাক্টরে তোলা হচ্ছে গড়ে ১২০ ঘনফুট বালু; এর বাজারমূল্য প্রায় ৫ হাজার টাকা। প্রতিরাতে ৭০ থেকে ৮০টি ট্রাক্টরে বালু পরিবহন করা হয়। গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার বালু অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে। মাসিক হিসাবে এই অঙ্ক কোটি টাকার বেশি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, সিলিকা বালুর নেশায় হবিগঞ্জ জেলার প্রকৃতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রশাসনকে বারবার বিষয়টি দেখানো হলেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

সিলিকা বালু লুটপাটের সঙ্গে কারা জড়িত, এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে বেশ কিছু নাম জানা গেছে। মাধবপুরে বালু উত্তোলনে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পারভেজ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তাঁর সহকারী হিসেবে রয়েছেন উপজেলার চৌমুহনী ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও বিএনপি নেতা জালাল মেম্বার। এই চক্র শাহজাহানপুর ইউনিয়নের সুরমা চা-বাগান, তেলিয়াপাড়া চা-বাগান, বনগাঁও, ভাণ্ডুরা, ইটাখোলা ছড়া, চৌমুহনী ইউনিয়নের রসুলপুর এবং তুলসীপুর থেকে সিলিকা বালু উত্তোলন করা হয়।

ইউপি সদস্য জালাল মোবাইলে বলেন, তিনি ও পারভেজ চেয়ারম্যান উপজেলার মনতলা নামক স্থান থেকে বৈধভাবে বালুমহালের ইজারা নিয়েছেন। যদিও বিভিন্ন স্থান থেকে সিলিকা বালু উত্তোলনে তাঁদের নাম আসা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এর সদুত্তর দেননি।

তবে মাধবপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মুজিবুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সিলিকা বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে প্রশাসন। এরই মধ্যে এই উপজেলায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া বালু পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্টর আটক করা হয়েছে।

সিলিকা বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যখন অভিযানে যাই, তখন তাদের পাই না। যে কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিদিন বড় বড় ট্রাকে বালু পরিবহন করা হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তাঁদের সঙ্গে প্রশাসনেরও সখ্য রয়েছে। যে কারণে নীরবে এসব সহ্য করতে হচ্ছে এলাকাবাসীর।

সাতছড়ি ত্রিপুরাপল্লির হেডম্যান চিত্ত রঞ্জন দেববর্মা বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর আগে আমাদের টিলার চারপাশ থেকে প্রচুর সিলিকা বালু উত্তোলন করা হয়েছিল; যার খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে। বৃষ্টি এলেই টিলায় ধস নামছে। এখন পর্যন্ত ১০টি পরিবার ত্রিপুরাপল্লি ছেড়েছে।’

চুনারুঘাট উপজেলার শানখলা ইউনিয়নের পানছড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে দেউন্দি চা-বাগান পর্যন্ত ৬ সদস্যের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট বালু উত্তোলন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামের মাহফুজ মিয়া, রিংকু মিয়া, বাবলু মিয়া, মাসুক মিয়া, ইউপি সদস্য ফয়েজ মিয়া ও মহিমাউড়া গ্রামের কাউসার মিয়া। এ ছাড়া এই উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সিলিকা বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন আবদুল্লাহপুর গ্রামের শাহজাহান মিয়া, কাঠালবাড়ি গ্রামের খয়ের মিয়া তালুকদার ও মিষ্টু মিয়া, হলহলিয়া গ্রামের জসিম মিয়া, পাইকপাড়া গ্রামের মো. রমজান আলী, সাঁটিয়াজুরী ইউনিয়নের দারাগাও দেওছড়া থেকে যুবলীগ সভাপতি কাউসার মিয়া ও স্থানীয় রুস্তম আলী।

প্রশাসন কী করে

বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, হবিগঞ্জের সব কটি চা-বাগান ও রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে দিন-রাতে বালু উত্তোলনের খবর পাওয়া যায়। প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তা বন্ধ হয় না। এখনো যদি সিলিকা বালু উত্তোলন বন্ধ না করা হয়, আর কয়েক বছর পর হবিগঞ্জের পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিপর্যয় নেমে আসবে।

এই বালু উত্তোলন নিয়ে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন চুনারুঘাটের সদ্য সাবেক ইউএনও মোহাম্মদ রবিন মিয়া। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রশাসন থেকে সিলিকা বালুর কোনো মহাল ইজারা দেওয়া হয়নি। তবে রাতের আঁধারে প্রভাবশালীরা বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। আমরা খবর পেলে অভিযান চালাই। বালু উত্তোলনের মেশিন ধ্বংস করার পাশাপাশি জরিমানা ও মামলা দিচ্ছি। তবে লোকবলের অভাবে পুরোপুরি উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, হবিগঞ্জে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্পকারখানায় এসব সিলিকা বালু বিক্রি হচ্ছে। যদি পুলিশ বালু পরিবহনের রাস্তাগুলোতে চেকপোস্ট বসায়, তাহলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত