Ajker Patrika

টিটিই মিঠুর আন্তরিকতায় চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ রোগীর সেবায় ছুটলেন সবাই

শাহীন রহমান, পাবনা 
টিটিই মিঠুর আন্তরিকতায় চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ রোগীর সেবায় ছুটলেন সবাই

রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে নীলফামারীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় একটি আন্তনগর ট্রেন। হঠাৎ চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়েন এক তরুণী। প্রচণ্ড কোমর ব্যথা সঙ্গে বমি, হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। তরুণীর সঙ্গে থাকা চাচা-চাচি উদ্বিগ্ন। চাচা সহযোগিতা চাইলেন ট্রেনের টিটিই’র কাছে। সেই টিটিই’র আন্তরিকতা আর চেষ্টায় ট্রেনে থাকা কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স মিলে সুস্থ করে তোলেন মুমূর্ষু সেই তরুণীকে। 

এমনই এক মানবিক ঘটনা ঘটেছে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা-সৈয়দপুরগামী ‘চিলাহাটি এক্সপ্রেস’ ট্রেনের মধ্যে। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ তরুণীর চিকিৎসায় যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে গেছেন সবাই। 

সুস্থ হয়ে ওঠা তরুণীর নাম সুমনা আক্তার (১৯)। তিনি নীলফামারী সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের পূর্ব চেংমারি গ্রামের মোক্তাহারুল ইসলামের মেয়ে। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছেন সুমনা। 

সুমনার চাচা মশিউর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঢাকায় আমার বাসায় বেড়াতে আসে ভাতিজি সুমনা। মাস খানেক থাকার পর গতকাল পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের জ বগিতে ছিলাম আমরা। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর কোমর ব্যথায় কাতরাতে থাকে সুমনা। ধীরে ধীরে ব্যথা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল, বমি করছিল।’ 

ট্রেনের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘টিকিট চেকিং করছিলাম। মৌচাক স্টেশন পার হওয়ার পর জ কোচের মাঝখানের যাত্রী মশিউর রহমান আমার কাছে সহযোগিতা চাইলেন তাঁর ভাতিজি ভীষণ অসুস্থ। তিনি ব্যথার ওষুধ চাইলেন। তখন ট্রেনে আমাদের কাছে ব্যথার ওষুধ ছিল না। আমি টাঙ্গাইল স্টেশনে ফোন দিলাম। তারা জানাল ওষুধের দোকান স্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। তাই সম্ভব নয়।’ 

টিটিই আরও বলেন, ‘মেয়েটির চাচা আমাদের কাছে ট্রেনে কোনো ডাক্তার আছে কিনা সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে বললেন। তৎক্ষণাৎ উচ্চ স্বরে নিজ মুখেই ঘোষণা করি, ‘‘একজন মেয়ে যাত্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি ডাক্তার থাকেন, তবে আপনার মানবিক সাহায্য কামনা করছি।’ ’ তখন এক যাত্রী নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে আসেন। আমি তাঁকে রোগীর কাছে নিয়ে যাই।’ 

‘ট্রেনের পিএ অপারেটরের ঘোষণার পর আরও দু’জন ডাক্তার এবং একজন নার্স সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। তিনজন ডাক্তার মিলে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। রোগীর প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে তাঁরা কাছাকাছি কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে বলেন। কিন্তু রোগী যাবেন না। এরপর ডাক্তাররা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কিছু ওষুধের চাহিদা দিলেন।’ যুক্ত করেন টিটিই। 
 
টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব রেলওয়ে স্টেশনে ওষুধ সংগ্রহের বিষয়ে যোগাযোগ করলে তারা জানায় সেখান থেকে ফার্মেসি অনেক দূরে, ওষুধ পাওয়া সম্ভব না। ট্রেনের ভেতরেই কোনো যাত্রীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ওষুধ আছে কিনা এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে পিএ অপারেটর ব্যবস্থায় ঘোষণা দিতে বললাম। ঘোষণা শুনে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে এলেন ব্যথার ওষুধ। ডাক্তাররা গরম পানির সেঁক দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। ক্যানটিন থেকে গরম পানির সেঁক দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু রোগীর যে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।’ 

টিটিই মিঠু বলেন, ‘এরপর ডাক্তাররা ব্যথানাশক সাপোজিটরির ব্যবস্থা করতে বললেন। ট্রেনের পরিচালককে অনুরোধ করলাম ট্রেনটি ধীর গতিতে করার। ট্রেন পরিচালক রাজি হলে বড়ালব্রিজের বুকিং সহকারী মামুন ভাইয়ের মাধ্যমে বড়ালব্রিজ স্টেশনে ওষুধগুলো নিয়ে দ্রুত ডাক্তারকে বুঝিয়ে দিলাম।’ 

প্রতিক্রিয়ায় আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ‘ট্রেনে এমন অনেক মানবিক ঘটনা ঘটে। অনেকে নানা রকম সমস্যায় পড়েন। আমাদের সহযোগিতা চাইলে সাধ্যমতো সহযোগিতা করি। মেয়েটির অসুস্থতার বিষয়টিও তেমনি একটি ঘটনা। তবে ভালো লাগার ব্যাপার হলো মানুষের মধ্যে মানবিক, মূল্যবোধ, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা অনেকের মাঝে আছে। এমন কাজ করতে পেরে নিজের কাছে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।’ 

সুমনার চাচা মশিউর রহমান বলেন, ‘ট্রেনের টিটিই থেকে শুরু করে ডাক্তার, নার্স যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ালেন তাতে আমি সত্যি মুগ্ধ। তা ছাড়া আমার ভাতিজির যে অবস্থা ছিল খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। প্রাথমিক চিকিৎসায় সে সুস্থবোধ করে। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে কেমন অবস্থা হয় তা ভুক্তভোগীরা জানে। আর এভাবেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সবার প্রতি আমাদের ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা জানাই।’ 

তরুণীটির চিকিৎসায় সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসক মো. ফাহিম উদ্দিন, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মো. শামসুল ইসলাম ও মো. নাজমুল হুদা। তাঁদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সহযোগিতায় ছিলেন একজন নার্স (নাম জানা যায়নি), চিলাহাটি এক্সপ্রেসের পরিচালক বিশ্বজিৎ রায়, টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু, টিটিই আমিরুল হক জাহেদী, এসি অপারেটর দীন ইসলাম, সৈয়দপুর জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল হক, ক্যানটিন বয় রাকিবুল ইসলাম। 

সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শামসুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে আমরা তিনজন ডাক্তার ছুটে যাই। আমরা ডাক্তাররা তো সেবার জন্য কাজ করি। সে জন্য দায়িত্ববোধ থেকে মেয়েটির চিকিৎসা এগিয়ে গিয়েছি। এ ছাড়া আমরা যখন যেটা চেয়েছি মেয়েটির চিকিৎসার জন্য মানুষ তাৎক্ষণিক যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে সহযোগিতায় ছুটে এসেছে। এটি ভালো দিক। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের উত্তরবঙ্গের মানুষ একটু বেশি মানবিক, আন্তরিক।’ 

এর আগে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাতে এই একই ট্রেনের ঘ নম্বর বগিতে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর যাওয়ার পথে চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়েন এক অন্ত: সত্ত্বা নারী। শুরু হয় রক্তপাত। ট্রেনের লাউড স্পিকারে ঘোষণা দিয়ে চিকিৎসকের খোঁজ করা হয়। ঘোষণা শুনে একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ও দুজন নার্স ছুটে আসেন। নারী যাত্রীরা তাঁদের কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখেন স্থানটি। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনের তিন চেয়ারের একটি আসন অস্ত্রোপচার কক্ষ হয়ে ওঠে। তবে ওই নারীর মৃত সন্তান প্রসব হলেও, প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এ ঘটনা ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

পিটুনিতে নিহত সেই শামীম মোল্লাকে বহিষ্কার করল জাবি প্রশাসন, সমালোচনার ঝড়

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

মধুপুরে বিদ্যালয়ে ঢুকে শিক্ষককে জুতাপেটা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত