Ajker Patrika

বগুড়ায় ৯ মাসে নিখোঁজ শিক্ষার্থীসহ ১৮০ নারী, নেপথ্যে প্রেম-পরকীয়া

গনেশ দাস, বগুড়া
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১৭: ৩৯
বগুড়ায় ৯ মাসে নিখোঁজ শিক্ষার্থীসহ ১৮০ নারী, নেপথ্যে প্রেম-পরকীয়া

বিয়ের তিন দিন পর স্বামীর সঙ্গে মার্কেটে যায় বগুড়া শহরতলির চক আলম গ্রামের এক স্কুলছাত্রী। স্বামী ফল কেনার সুযোগে পাশ থেকে সে লাপাত্তা হয়ে যায়। পরে স্ত্রীর ফোন বন্ধ পেয়ে বিষয়টি শ্বশুরকে জানান স্কুলছাত্রীর স্বামী। স্কুলছাত্রীর বাবা প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণের অভিযোগ করেন একই এলাকার এক যুবকের বিরুদ্ধে।

৩ অক্টোবর বিকেলে বগুড়া শহরের চেলোপাড়া এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে। তবে, পুলিশ এই অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ায় ওই স্কুলছাত্রী তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে।

আরেকটি ঘটনা ঘটে গত ২ জুন সকালে। বগুড়া শহরতলির কুটুরবাড়ি গ্রামের নবম শ্রেণি পড়ুয়া এক মাদ্রাসাছাত্রী মাদ্রাসায় গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। কয়েক দিন পর ওই ছাত্রী বাড়িতে কল দিয়ে জানায় ফেসবুকে মাগুরা জেলার এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় সেই ছেলের সঙ্গে সে স্বেচ্ছায় চলে গেছে।

সেই সঙ্গে মা-বাবাকে থানায় মামলা না করার পরামর্শ দিয়ে ওই মাদ্রাসাছাত্রী ইমোর মাধ্যমে তাদের বিয়ের কাবিননামা এবং ঢাকায় যেখানে অবস্থান করছে সেখানকার ঠিকানা পাঠিয়ে দেয়। কিছুদিন পর তার বাবা ঢাকায় গিয়ে মেয়ের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারেন, মাগুরায় ওই ছেলের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। কিন্তু মেয়েকে ফেরাতে না পেরে, শেষ পর্যন্ত ৩ অক্টোবর বগুড়া সদর থানায় অভিযোগ করেছেন।

উল্লিখিত দুই কিশোরীই নয়, বগুড়া সদর থানা-পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে বগুড়া শহর এবং শহরতলি থেকে এ ধরনের অভিযোগ এসেছে ১৮০টি। অভিযোগে নিখোঁজ কিংবা অপহরণের কথা উল্লেখ করা হলেও, প্রত্যেকটি নিখোঁজের পেছনে প্রেম এবং পরকীয়া জড়িত।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—থানায় দায়ের হওয়া ১৮০টি অভিযোগের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী নিখোঁজেরই অভিযোগ ১৫০টি। বাকি ৩০টি অভিযোগ বিবাহিত নারী স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা।

গত ৯ মাসের এ তথ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বগুড়া জেলার শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকেরা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছে, সম্পদ অর্জনে ব্যস্ত হওয়ায়, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।

বগুড়া সদর থানার নথি থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে মানুষ নিখোঁজ বা হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ২১০টি। ছয়জন ব্যতীত সবাইকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জিডি হয়েছে ১৮টি এবং ১২টি জিডি হয়েছে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে হারিয়ে যাওয়া ছাত্র নিখোঁজের ঘটনায়। তবে বাকি ১৮০টি ডায়েরি হয়েছে শিক্ষার্থী ও গৃহবধূ নিখোঁজের।

থানা-পুলিশ বলছে, নিখোঁজ হওয়া শিক্ষার্থী ও নারীদের মধ্যে ছয়জনকে পুলিশ এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। তবে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় ৭০ জন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে জিডির বিপরীতে অপহরণ মামলা হয়েছে। বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে উদ্ধার হওয়ার পরে তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছেন, আগের স্বামীকে তালাক দিয়েই তাঁরা অন্যজনের সঙ্গে পালিয়েছেন। ফলে স্বামীর পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি।

অন্যদিকে মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে নিখোঁজ সব শিক্ষার্থীকেই উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের পর তারা পুলিশকে জানিয়েছে, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় মারধর করায় তারা পালিয়ে যায়। এ ছাড়া ১৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মধ্যে ১৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বৃদ্ধও রয়েছেন। উদ্ধারের পর তাঁরা জানিয়েছেন, পরিবারের সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন।

তবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী তিনজন যুবক এখনো উদ্ধার হয়নি। তাঁরা অভিমান করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে জানিয়েছে পরিবার। এর পর থেকে তাঁরা আর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এমনকি তাঁদের ব্যবহৃত কোনো মোবাইল ফোন নম্বর পুলিশ কিংবা পরিবার সংগ্রহ করতে পারেনি।

এ বিষয়ে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইহান ওলিউল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থী কিংবা বিবাহিত নারী নিখোঁজ-সংক্রান্ত অভিযোগ এলে প্রাথমিক পর্যায়ে জিডি গ্রহণ করা হয়। পরে নিখোঁজ শিক্ষার্থী কিংবা নারীর অবস্থান শনাক্ত করে উদ্ধারের পর তারা জানায়, প্রেমঘটিত কারণে তারা বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। উদ্ধারের পর অনেকেই মামলা করতে চায়নি। যার কারণে সব ক্ষেত্রে মামলা হয়নি।’

ওসি আরও বলেন, ‘২১০টি হারানো জিডির মধ্যে ১৮০টি প্রেমঘটিত ঘটনা। এসব জিডির বেশিসংখ্যক নিষ্পত্তি হয়েছে। কয়েকটি হারানো জিডি নিয়ে কাজ চলছে। হারানো শিক্ষার্থী কিংবা নারীকে উদ্ধারের পর পরিবারের অনেকেই মামলা করতে চায় না। যার কারণে সব ক্ষেত্রে মামলা হয় না। তারপরও ৭০টি জিডি পরে অপহরণ মামলা হয়েছে।’

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক সুবহানা লীনা হাসিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ষষ্ঠ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বয়সটা ভুল করার। আমাদের পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। মা-বাবা উভয়েই কর্মব্যস্ততার কারণে সন্তানদের সময় দিতে পারে না। তারা স্কুলে কিংবা কোচিংয়ের নামে বাইরে কী করে, সে সম্পর্কে অনেকের ধারণা থাকে না।’ 

লীনা হাসিন বলেন আরও বলেন, ‘একটা সময় সম্পদ নিয়ে মানুষের চিন্তা কম ছিল। পরিবারের সন্তানকেই সম্পদ হিসেবে মনে করা হতো। আর এখন যে যার অবস্থান থেকে সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনের অপব্যবহার এসবের পেছনে কাজ করে। এ ছাড়া স্ত্রীকে রেখে দীর্ঘ সময় বিদেশ থাকা, সঠিকভাবে স্ত্রীর খোঁজখবর না নেওয়া, স্ত্রীকে না বোঝাসহ অসংখ্য কারণ রয়েছে নারীদের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার।’

এ ছাড়া পারিবারিক বন্ধন শক্ত করার পাশাপাশি সন্তানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে না দেওয়া। পরিবারকে সময় দেওয়া, সন্তান ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তার সঙ্গে কঠোর আচরণ না করে, কাউন্সেলিংয়ের পরামর্শ দিয়েছে এ শিক্ষক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত