Ajker Patrika

‘সে সময় পুলিশ আইসাও অনেক অত্যাচার করছে’

অভিজিৎ সাহা, নালিতাবাড়ী (শেরপুর)
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২১, ২২: ২৭
‘সে সময় পুলিশ আইসাও অনেক অত্যাচার করছে’

'ছোট বেলা বিয়ে হইছে। বিয়ের পরপরই স্বামী মুক্তিযুদ্ধে চইলা গেছিল। আর শেখ মুজিবুর রহমানরে সপরিবারে হত্যা করলে তিনি আবার যুদ্ধে গেছিলেন। তখন আমার কোলে এক মেয়ে বাচ্চা। মেয়েটার বয়স ৬ মাস। মাত্রই মুখে ভাত দেওয়ার অনুষ্ঠান হইছিল। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। সে সময় খবর পাইছিলাম যে আমার স্বামীরে মাইরা ফেলছে। কিন্তু তাঁর লাশটাও আনতে পারি নাই।' কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা গুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের দিকপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিরোধ যোদ্ধা জয়েশ্বর বর্মণের স্ত্রী কনকা বর্মণ। 

কনকা বর্মণ আরও বলেন, 'সে সময় পুলিশ আইসাও অনেক অত্যাচার করছে। অস্ত্র আছে এই সন্দেহে আমার শ্বশুর আর দেবরকে অনেক মারধর করছে। সে সময় দেবরের কোমর ভেঙে গেছিল। সে এখনো সোজা হইয়া হাঁটতে পারে না। কিন্তু আমাদের কাছে তো কোনো অস্ত্রই ছিল না। এহন একটা ভাঙা চূড়া ঘরে থাকি। দেবর যদি না দেখত তবে তো আমার পথে ঘুরতে হইতো। স্বামীর মুখটা যখন চোখে ভাসে তখন আর এই দুনিয়ায় থাকতে মন চায় না। বনের আগুন তো সবাই দেখে কিন্তু মনের আগুন কয়জন দেখে? '

অন্যদিকে, সাত বছরের এক ছেলে ও তিন বছরের এক মেয়েকে রেখে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ জানাতে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়েছিলেন উপজেলার জাঙ্গালিয়াকান্দা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনন্ত চন্দ্র বর্মণ। কিন্তু আর ফিরে আসেননি তিনি। তাঁর লাশও পায়নি পরিবার। স্বামী জীবিত আছেন এই আশায় প্রায় ১২ বছর অপেক্ষা করার পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন তাঁর স্ত্রী খুকী বর্মণ। 

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী জয়েশ্বর বর্মণের স্ত্রী ও সে সময় পুলিশের অত্যাচারে কোমর ভেঙে যাওয়া তাঁর ভাইখুকী বর্মণ বলেন, 'স্বামী ফিরা আসব এই আশায় সন্তান দুইটারে নিয়া অনেক কষ্টে দিন কাটাইছি। কিন্তু ১২ বছর পার হইয়া গেলেও যখন সে ফিরে নাই, তখন মাইনাই নিছি সে মারা গেছে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় তখন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করি। মেয়েটারে বিয়ে দিছি। ছেলেটারেও বিয়া করাইছি। দুইটা নাতিও আছে। সবাই মিলা ভাঙচুর ঝুপড়ি ঘরটায় থাকি। বসত ভিটা টুকু ছাড়া আর কিছুই নাই। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তো পাই কয়দিন ধইরা। ছেলেটা খেতে কাজ করে। আজ স্বামী বাঁইচা থাকলে এমুন কষ্ট হইত না।' 

উপজেলার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে উপজেলার সীমান্তবর্তী চৌকিদার টিলায় একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও যুবক প্রতিশোধ নিতে এক মাস প্রশিক্ষণ নেন। পরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার চান্দুভই এলাকায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়। যোদ্ধারা কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় নানা কর্মকাণ্ড চালান। তখন বিভিন্ন স্থানে বিডিআর (বিজিবি) ও পুলিশ সদস্যের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। এতে অনেকেই প্রাণ হারান। ২২ মাস পর নানা নির্যাতন ও পরাজয়ের গ্লানি ভোগ করে তারা ফিরে আসেন। এদের মধ্যে আজগর আলী, শফিকুল ইসলাম, জিনাত আলী, গৌরাঙ্গ পাল ১০ বছর করে কারাভোগ করেন বলে জানা যায়। 

উপজেলা প্রতিরোধযোদ্ধা পরিষদের সভাপতি ফজলুল হক বলেন, `বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীরা নানা ভাবে অবহেলিত। আমরা না পাইলাম সম্মান, না পাইলাম স্বীকৃতি। সে সময় নিহত অনেকের পরিবারেরই আজ দুরবস্থা। এ ছাড়া জীবিত সবাই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা হয় না। অনেকের কাজ করা শক্তি ও সামর্থ্য নেই।' প্রতিরোধযোদ্ধাদের জাতীয়ভাবে একটা স্বীকৃতি দিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত