Ajker Patrika

শিকলে বাঁধা কিশোর শান্ত, দেখতে গেলেন কুষ্টিয়ার ডিসি

দেবাশীষ দত্ত, কুষ্টিয়া 
আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ২০: ৫৭
শান্ত হোসেনকে দেখতে ছাতিয়ান ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে যান কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. ইকবাল হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
শান্ত হোসেনকে দেখতে ছাতিয়ান ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে যান কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. ইকবাল হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে শান্ত হোসেন। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণহীন। ময়লা-আবর্জনা খাওয়া, বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙচুর, নিজেকেই আঘাত করার প্রবণতা দেখে একসময় পরিবার বুঝতে পারে, এটা আর সাধারণ সমস্যা নয়। কিন্তু দিনমজুর বাবার পক্ষে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

তাই বাধ্য হয়ে আট বছর বয়স থেকে দড়ি, পরে শিকলে বাঁধা অবস্থায় বেড়ে উঠছে শান্ত। নিরাপত্তার জন্যই এমন ব্যবস্থা। তবু প্রতিদিন বাবা-মায়ের বুকফাটা কান্নার গল্প শুধু বাড়ছে।

শান্ত হোসেনকে দেখতে ছাতিয়ান ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে যান কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. ইকবাল হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
শান্ত হোসেনকে দেখতে ছাতিয়ান ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে যান কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. ইকবাল হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

শান্ত কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের ছাতিয়ান উত্তরপাড়া গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে। তার বয়স এখন ১৪।

তবে সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকেরা শান্তর করুণ অবস্থা তুলে ধরেছেন কুষ্টিয়ার নবাগত জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইকবাল হোসেনের কাছে। অতঃপর গত সোমবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে শান্তর বাড়িতে হাজির হন জেলা প্রশাসক।

তাঁর সঙ্গে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা। জেলা প্রশাসক তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে শান্তর চিকিৎসা শুরুর তাগিদ দেন।

দিনমজুর জসিম উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, উঠানের মাঝে পাটি বিছানো। পাটিতে বসে আছে শান্ত। গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে তার পা বাঁধা। প্রথমে তার নাম বলতে পারলেও পরে আর কোনো কথা বলেনি।

এ সময় বাবা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বয়স যখন সাড়ে তিন বছর, তখন খেয়াল করলাম ছেলের অস্বাভাবিক আচরণ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল আচরণও বাড়তে থাকে। এলাকার মানুষের বাড়িঘর, থালা-বাটি থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেখামাত্রই ভেঙে ফেলতে শুরু করে। একপর্যায়ে রাস্তার পাশের ড্রেনের ময়লা, মুরগি, গরু-ছাগলের বিষ্ঠা খেতে শুরু করে। অস্বাভাবিক আচরণের জন্য ২০১৯ সালে বয়স যখন আট বছর, তখন থেকে শান্তকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখি।

‘এমন অবস্থায় অসচ্ছলতার ভেতরেও ছেলেকে রাজশাহীতে চিকিৎসা করিয়েছি। ছয় মাসে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয় ১৭ হাজার টাকা। চিকিৎসার পর ময়লা-আবর্জনা খাওয়া বন্ধ করে শান্ত। কিন্তু অর্থের অভাবে ২০২০ সালের পর থেকে ছেলের আর চিকিৎসা করাতে পারি নাই। এখন শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। চিকিৎসক বলেছেন, নার্ভের সমস্যা। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করালে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।’

জসিম উদ্দিন আরও বলেন, ‘আমি দিনমজুর মানুষ। তিন ছেলের মধ্যে শান্ত বড়। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া ১২ কাঠা জমি ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই। কোনো রকম টেনেটুনে সংসার চলে। এর ভেতর চিকিৎসার খরচ বহন করা কঠিন। এই অবস্থা দেখে সমাজসেবা অফিসার ছেলের ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৭০০ টাকা পাই। সেই টাকা দিয়ে ছেলের থালা, বাটি, পোশাক কিনে দেই।

‘কয়েক দিন আগে ডিসি স্যার বাড়িতে এসে ছেলেকে দেখে গেছেন। তিনি চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। আগামী সোমবার ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাব।’

রাতে শান্ত মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমায়। বাকি সময় জেগে থাকে। ছেলের এমন পরিণতি দেখে মা সীমা খাতুনও অসহায়। চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, ‘ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে আমার ছেলে।’

স্নায়ুরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমিও একটি ভিডিওতে বিষয়টি দেখেছি। এ ক্ষেত্রে প্রথমে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ছাড়া নিউরোলজিসহ অন্য বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে। এরপর বলা যাবে ছেলেটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে কি না।’

মিরপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মারফত আফ্রিদী বলেন, ‘মিরপুর উপজেলায় অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় শান্তর বিষয়টি তুলে ধরা হলে ডিসি মহোদয় সাড়া দেন। তিনি শান্তকে দেখতে যান এবং চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান মানুষদেরও এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি।’

মিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নাজমুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডিসি স্যার ছেলেটির চিকিৎসা শুরুর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী আজ বুধবার ওই পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে চিকিৎসাসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে সহযোগিতা দেওয়া হবে।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘শান্তর চিকিৎসা সহায়তার জন্য ইউএনওকে নির্দেশনা দিয়েছি। যেহেতু চিকিৎসায় ওষুধ কিনতে খরচ রয়েছে, সে জন্য প্রাথমিকভাবে শান্তর বাবার হাতে আজকে আর্থিক সহায়তা তুলে দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ সহযোগিতা ডিসি ফান্ড থেকে দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, ভবিষ্যতে আমার জায়গায় যে ডিসি স্যার আসবেন, তিনিও শান্তর ব্যাপারে আন্তরিক হবেন। আশা করি, অন্যরাও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...