Ajker Patrika

বিলুপ্তির পথে মাদুরশিল্প: ৭৫ বছর ধরে লড়ছেন শতায়ু সুনীল

সেলিম হায়দার, তালা (সাতক্ষীরা) 
বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও প্রতিদিন সকালে ৭-৮ কিলোমিটার পথ হেঁটে সুনীল তালা বাজারে আসেন মাদুর বিক্রি করতে। ছবি: আজকের পত্রিকা
বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও প্রতিদিন সকালে ৭-৮ কিলোমিটার পথ হেঁটে সুনীল তালা বাজারে আসেন মাদুর বিক্রি করতে। ছবি: আজকের পত্রিকা

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প—মাদুর নির্মাণ। শিল্পটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে। কাঁচামালের সংকট, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং আধুনিক প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে প্রায় বিলুপ্তির মুখে এই প্রাচীন শিল্প। একসময় তালা উপজেলার ২০০ থেকে ৩০০ পরিবার মাদুরশিল্পের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

তবে এই শিল্পের সঙ্গে একটি নাম খুব দৃঢ়ভাবে টিকে আছে। তিনি হলেন মাদরা গ্রামের সুনীল মণ্ডল। বয়স প্রায় ১১০ বছর। প্রায় ৭৫ বছর ধরে তিনি মাদুর তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও প্রতিদিন সকালে ৭-৮ কিলোমিটার পথ হেঁটে তালা বাজারে আসেন মাদুর বিক্রি করতে।

আজ বুধবার (১১ জুন) সকালে তালা বাজারে দেখা যায় তাঁকে। মাথায় কাপড় পেঁচানো, হাতে বাঁধা এক জোড়া মাদুর। কথা হলে তিনি বলেন, ‘এই পেশা বাপ-দাদার আমল থেকে করে আসছি। ইচ্ছা হলেও ছাড়তে পারি না। যদি বিক্রি হয়, ভালো; না হলে আবার হেঁটেই বাড়ি ফিরি।’

তিনি জানান, এক সময় তাঁদের গ্রামের অনেক পুরুষ ও নারী মাদুর তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা মাত্র দুই-এক পরিবারে নেমে এসেছে। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে—বড় ছেলে ব্যবসা করেন, ছোট ছেলে মাছ চাষ করেন। কিন্তু কেউই আর এই পেশায় আসেননি।

মাদুর তৈরির প্রধান উপকরণ ‘মেলে ঘাস’। এটি পাওয়া যেত খাল-বিল, জলাশয় ও নদীর চরে। কিন্তু এখন সেই মেলে ঘাস আর আগের মতো জন্মায় না। চাষও করা হয় না।

সুনীল মণ্ডল বলেন, ‘আগে কাউন মেলের দাম ছিল ২৮০-৩০০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৫০০-৬০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। মাঝারি মানের এক জোড়া মাদুর তৈরিতে খরচ পড়ে ৫০০-৭০০ টাকা। অথচ পাইকারি দামে বিক্রি হয় মাত্র ৮০০ টাকা। লাভের টাকায় সংসার চালানো যায় না।’

প্রায় ৭৫ বছর ধরে সুনীল মাদুর তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। ছবি: আজকের পত্রিকা
প্রায় ৭৫ বছর ধরে সুনীল মাদুর তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। ছবি: আজকের পত্রিকা

তালা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাজিরা খাতুন বলেন, ‘মাদুর তৈরির কাঁচামাল এখন খুব একটা পাওয়া যায় না। মেলে চাষের উদ্যোগও নেই। তার ওপর প্লাস্টিকের মাদুর সস্তা ও টেকসই বলে বাজারে চাহিদা বেশি। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্প থেকে কারিগরেরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।’

হাজিরা খাতুন আরও বলেন, ‘পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে এই শিল্প আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কাঁচামাল সরবরাহ, প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়ব্যবস্থায় সহায়তা পেলে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করা যেতে পারে।’

সুনীল মণ্ডলের মতো একজন শতায়ু মানুষ আজও মাদুর বুনে জীবিকার সন্ধান করছেন, এটা যেমন অবাক হওয়ার মতো, তেমনি কষ্টেরও। যে শিল্প একসময় একটি অঞ্চলের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল, তা আজ নিঃশেষ হতে বসেছে—পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার নজরদারি না থাকলে ইতিহাসের পাতায় হয়তো অচিরেই লেখা হবে—‘তালা উপজেলার মাদুরশিল্প, এক হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত