Ajker Patrika

পদ্মা সেতু: স্বপ্ন দিচ্ছে হাতছানি

প্রতিনিধি
আপডেট : ২৬ জুন ২০২১, ১১: ৪৯
পদ্মা সেতু: স্বপ্ন দিচ্ছে হাতছানি

শিবচর (মাদারীপুর): প্রমত্ত পদ্মায় বাড়ছে পানি। বাড়ছে ঢেউ আর স্রোতের গতি। ঢেউ আর স্রোতকে তুচ্ছজ্ঞান করে প্রমত্ত পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে স্বপ্নের সেতুটি সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে খরস্রোতা পদ্মার তীব্র স্রোত উপেক্ষা করে।

বরিশালের উজিরপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন কহিনূর বেগম। লকডাউনে লঞ্চ বন্ধ থাকায় ফেরিতে পার হতে হয়েছে তাঁকে। শুক্রবার একটি রো–রো ফেরিতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ফেরিটি শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে শিমুলিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার পথে কিছুটা দূর গেলেই চোখের সামনে ফুটে ওঠে পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো। ফেরিতে বসা কহিনূূরসহ অন্য যাত্রীদের চোখও তখন পদ্মা সেতুর দিকে। ফেরিটি সেতুর ঠিক নিচ দিয়ে অতিক্রম করার সময় যাত্রীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসপূর্ণ ধ্বনি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সেতু ছেড়ে ফেরি যত এগোতে থাকে, পেছনে তাকাতে ততই সেতুর কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধরা পড়ে চোখের সামনে। কহিনূর বেগম বলেন, ‘পদ্মা সেতু ছিল আমাদের দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্ন। মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের সেতু চোখের সামনে দেখতে দেখতেই তৈরি হয়ে গেল। নৌপথের এই ভোগান্তির দিন শেষ হয়ে আসছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে বসে থেকে, গাদাগাদি করে ফেরিতে কষ্ট করতে হবে না।’

শিবচরের স্কুলশিক্ষক মো. আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘যখন লঞ্চ বা ফেরিতে পদ্মা পার হই, তখন খুব কাছ থেকে পদ্মা সেতু দেখতে পাই। সেতুর নিচ দিয়েই নৌযান চলাচল করে। পদ্মা পার হওয়ার পুরো পথেই তখন স্বপ্নের পদ্মা সেতু আমাদের হাতছানি দেয়। আসলে নৌযানে বসে পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভিন্নরকম অনুভূতি হয়। খুবই ভালো লাগে। সেতু চালু হয়ে গেলে আর ভোগান্তি থাকবে না পদ্মা পার হওয়ার। ঢাকায় যেতে–আসতে সময়ও লাগবে খুব কম। কোথাও থামতেই হবে না আর।’

ট্রাকচালক রুহুল আমিন বলেন, ‘ঘাটে দিনের পর দিন বসে থাকতে হয় পদ্মা পার হওয়ার জন্য। এই কষ্ট আমরা ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের পথে। পদ্মা সেতু দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দেই। আর তো অল্প কিছুদিন! তারপর আর ঘাটে আটকে থাকতে হবে না। একটানে পদ্মা নদী পার হওয়া যাবে তখন।’ 

পদ্মা সেতুসংলগ্ন শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাট এলাকার বাসিন্দা মাহফুজ বলেন, ‘দেখতে দেখতে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর জাজিরা পয়েন্টের সঙ্গে মাওয়ার সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে পুরো পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়। পদ্মা সেতুর একেকটি স্প্যান যখন বসানো হয়, তখন পদ্মাপারের মানুষের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। এই পদ্মা সেতুকে ঘিরেই আমাদের এই চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। যেসব এলাকায় কোনো রাস্তাঘাট ছিল না, বৃষ্টির দিনে চলাফেরা করতে কাদাপানিতে মাখামাখি হয়ে যেত, সেখানে আজ দৃষ্টিনন্দন সড়ক হয়েছে। পদ্মায় সেতু হবে এমন স্বপ্ন এ এলাকার মুরব্বিদের চোখেমুখে ছিল। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব হয়েছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিবচরের পদ্মাপারের এলাকাগুলোর উন্নয়ন হয়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার মান।’ 

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে শিমুলিয়ার উদ্দেশে নৌযান ছেড়ে যাওয়ার একটু পরেই পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর দেখা মেলে। নৌযান সেতুটির ঠিক কাছাকাছি এলেই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখা যায় যাত্রীদের। চলতে থাকে পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাসের আলাপন। স্বপ্ন বাস্তবায়নের গল্প। সেতুর কাছাকাছি এলে এর উচ্চতা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেককে। আর সেতুর ওপর দিয়ে বাড়ি ফেরার প্রত্যাশার গল্প তো রয়েছেই। কত দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারবে বা ঢাকায় যেতে পারবে, তার হিসাব-নিকাশও করতে থাকে যাত্রীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুতে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ১২ ও ১৩তম পিলারের ওপর ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মার দুই প্রান্তের সংযোগ স্থাপিত হয়। দৃশ্যমান হয় পুরো সেতু। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে বসানো হয় প্রথম স্প্যান। এরপর একের পর এক স্প্যান ওঠানোর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে থাকে সেতুর কাঠামো।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এই সেতু ঘিরে শিবচরসহ দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে। তা ছাড়া পদ্মা সেতু ঘিরে শিবচরের চরাঞ্চলে পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। পদ্মা সেতু দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এই পদ্মার পাড়ে আসে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে।’ 

বর্ষার পানিতে শান্ত পদ্মার চেহারা পাল্টে রুদ্ররূপ ধারণ করে। বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে পদ্মা। ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয় প্রমত্ত এ নদী। পদ্মা সেতু চালু হলে ঝুঁকি নিয়ে নৌপথ পাড়ি দেওয়ার দুশ্চিন্তা থাকবে না। তা ছাড়া দেড় থেকে দুই ঘণ্টার নৌপথ পার হওয়া যাবে চোখের পলকেই। এমন প্রত্যাশা নৌরুটের যাত্রীদের। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত