Ajker Patrika

জাতীয় ক্যানসার হাসপাতাল: অস্ত্রোপচার ও রেডিওথেরাপির জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা

  • প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রোগনির্ণয় সুবিধার ঘাটতি
  • প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছেন শত শত রোগী
  • ৫০০ শয্যার হলেও অনুমোদিত জনবল ৩০০
  • বাইরে থেকে সেবা নিতে বাড়ছে দরিদ্র রোগীর খরচ
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

চাঁদপুরের আশি-ঊর্ধ্ব আশরাফুল আলমের (ছদ্মনাম) দেড় বছর আগে পায়ুপথে ক্যানসার শনাক্ত হয়। চিকিৎসার জন্য তিনি রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ) আসেন। তখন থেকে এ পর্যন্ত ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে তাঁকে আটটি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন রেডিওথেরাপির। তারিখ পাওয়ার জন্য কয়েক মাস ধরে চেষ্টার পর অবশেষে গত মঙ্গলবার রেডিওথেরাপির তারিখ মিলেছে, তবে তা-ও দুই মাস পরের। এদিন এনআইসিআরএইচে আশরাফুল আলমসহ আরও কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসাসেবার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা জানা যায়।

রোগী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সারা দেশ থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী রাজধানীর এই হাসপাতালে আসেন। তাঁদের বড় অংশকেই হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়। ক্যানসারের চিকিৎসার আর্থিক বোঝা বহন করতে না পারা এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে বিশেষায়িত সেবা না থাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা এখানে ভিড় করেন। কিন্তু জনবলসহ সক্ষমতার ঘাটতি, অতিরিক্ত রোগীর চাপ এবং অব্যবস্থাপনার কারণে ক্যানসার চিকিৎসায় সরকারের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটি সব রোগীকে সময়মতো প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারছে না।

এনআইসিআরএইচের মূল ভবনের নিচতলায় রেডিওথেরাপি রেজিস্ট্রেশন কক্ষের বাইরে রোগী আশরাফুল এবং তাঁর মেয়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। মেয়ে জানান, বছরখানেক আগে তাঁর বাবার কেমোথেরাপি শেষ হয়েছে। তখন থেকে তাঁরা রেডিওথেরাপিসহ পরবর্তী চিকিৎসার জন্য নিয়মিত হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। পাঁচ-ছয়বার কাগজপত্র জমা দিয়েছেন।

রাজশাহীর কবিরের (ছদ্মনাম) মায়ের স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয় গত বছরের নভেম্বরে। ছয়টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। রোগী এখন অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় আছেন। গত মঙ্গলবার সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সামনে কথা বলার সময়

কবির জানান, মাকে ভর্তি করানোর জন্য দেড় মাস ধরে নিয়মিত হাসপাতালে যোগাযোগ করছেন। কবে ভর্তির তারিখ মিলবে, তা নিয়ে তিনি চরম উদ্বেগে আছেন।

বারবার যন্ত্র বিকলে ভোগান্তি

হাসপাতালের দুটি লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর (লিনাক) আড়াই বছর আগে এবং দুটি কোবাল্ট মেশিন দেড় বছর আগে অকেজো হয়ে যায়। এরপর থেকে বাকি দুটি লিনাক মেশিন দিয়ে প্রতিদিন ২০০-২৩০ জন রোগীর রেডিওথেরাপি চলছিল। গত ২১ ও ২২ ডিসেম্বর পর পর দুদিন একটি করে এ দুটি যন্ত্রও নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটিতে রেডিওথেরাপি দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন বসানো হয়। তবে সেগুলো দিয়ে থেরাপি দেওয়া চালু করতে কয়েক মাস লেগে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তির দরকার নেই, এমন প্রায় ৩০০ রোগীকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। আর রেডিওথেরাপি নিচ্ছেন দিনে প্রায় ২০০ রোগী।

দীর্ঘ অপেক্ষায় হতাশা ও ক্ষোভ

যশোরের সুলতান আহমেদের (ছদ্মনাম) ষাটোর্ধ্ব মায়ের জরায়ু ক্যানসার শনাক্ত হয় চলতি বছরের জুনে। এরপর চিকিৎসা নিতে এনআইসিআরএইচে আসেন তিনি। সেখানকার চিকিৎসক জানান, ক্যানসার তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করে চতুর্থ পর্যায়ে চলে যাওয়ায় দ্রুত কেমো ও রেডিওথেরাপি প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ অপেক্ষা এড়াতে তিনি প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচটি কেমোথেরাপি ও ২৬টি রেডিওথেরাপি সেশন করান। স্বল্প বেতনের এই চাকরিজীবী খরচে কুলাতে না পেরে ব্র্যাকিথেরাপির জন্য মাকে আবার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।

গত মঙ্গলবার রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের ১৫২ ও ১৫৩ নম্বর কক্ষে রেডিওথেরাপির নিবন্ধন ও পরিকল্পনা কার্যক্রম চলার সময় সেখানে ছিলেন এই প্রতিবেদক। এ সময় দেখা যায়, অনেক রোগী কাগজপত্র জমা দিয়ে তারিখের অপেক্ষায় বসে আছেন। স্পিকারে অন্য কারও তারিখ শুনে একজন নিজের ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মারা যাওয়ার পর রেডিও দিয়ো।’

একই চিত্র দেখা যায় মেডিকেল অনকোলজি বিভাগেও। কেমোথেরাপির তারিখ না পেয়ে অনেক রোগী বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত বছর হাসপাতালটিতে পৌনে ৩ লাখ রোগী বহির্বিভাগে, ১২ হাজার রোগী জরুরি বিভাগে এবং প্রায় ১৪ হাজার রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। সে বছর ২ হাজার ৭২২টি বড় এবং ৩১২টি ছোট অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে। শয্যার বিপরীতে ভর্তির হার শতভাগ হওয়ায় ভর্তি হতে অনেক রোগীকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।

রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের আবাসিক সার্জন মোহা. শাহীন ফেরদৌস বলেন, ‘ক্যানসারের চিকিৎসার নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। এটি নির্ভর করে ক্যানসারের ধরন এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। সাধারণত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে শয্যা খালি না থাকলে ভর্তি বা থেরাপির জন্য অপেক্ষা করতে হয়।’

প্রয়োজনীয় পরীক্ষার অভাব

ক্যানসার শনাক্ত ও চিকিৎসার জন্য সিটি স্ক্যান, এমআরআই, পেট-সিটি স্ক্যান, সিটি গাইডেড বায়োপসি ও ইকোকার্ডিওগ্রাফির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ব্যবস্থা হাসপাতালটিতে নেই। মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজি বিভাগেও অনেক পরীক্ষা করা যাচ্ছে না।

হাসপাতালের দুজন চিকিৎসক বলেছেন, ব্যয়বহুল পরীক্ষাগুলো এখানে করা সম্ভব হয় না। ফলে রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়, যা তাদের খরচ বাড়িয়ে দেয়।

এনআইসিআরএইচের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা নাহিদ হোসেন সেবার বিষয়ে বলেন, ‘সীমিত সম্পদের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ টেকনিশিয়ানের ঘাটতির কারণে রোগীদের প্রত্যাশিত সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।’

প্রয়োজনীয় জনবলের সংকট

এনআইসিআরএইচ ১৯৯১ সালে ৫০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৪ সালে এর নামকরণ হয় জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এটি ২০১৫ সালে ৩০০ শয্যা এবং ২০১৯ সালে ৫০০ শয্যায় উন্নীত হয়।

পরিচালকের কার্যালয় জানিয়েছে, ৫০০ শয্যার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও বাস্তবে জনবল রয়েছে ৩০০ শয্যার জন্য। অনুমোদিত অর্গানোগ্রামে ১ হাজার ১৮৮ জনবল থাকার কথা। ২৪৮ জন চিকিৎসকের বিপরীতে রয়েছেন ২০৪ জন। নার্সের (৫৫৫ জন) তেমন সংকট নেই। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, রেডিওথেরাপি এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ঘাটতি রয়েছে। পুরো ইনস্টিটিউটে গাড়িচালক মাত্র একজন।

এনআইসিআরএইচের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল) আবু হেনা মোর্শেদ জামান বলেন, ‘৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য অনুমোদিত জনবল ৩০০ শয্যার। এই জনবল দিয়ে ৫০০ শয্যার সেবা পরিচালনা করা কঠিন। তার ওপর ওই জনবলেরও পুরোটা এখানে নেই।’

ক্যানসারকে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, দেশে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার অন্যতম ক্যানসার এখনো যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আসেনি। অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে মনে করা হয়, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে চলেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে বার্ষিক মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে ঘটে, যার মধ্যে ক্যানসার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৩-১৫ লাখ প্রাক্কলিত ক্যানসার রোগী রয়েছে। বছরে নতুন রোগীর সংখ্যা ২-৩ লাখ। প্রাক্কলিত সংখ্যার তুলনায় কয়েক গুণ রোগী রোগ শনাক্তের বাইরে থেকে যায়।

ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুসারে, ক্যানসার রোগীর প্রায় ৫০ শতাংশের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি প্রয়োজন। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি রেডিওথেরাপি কেন্দ্র থাকা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে মোট ১৮০টি রেডিওথেরাপি মেশিন প্রয়োজন। তবে বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে রয়েছে ৩০টির কম। সরকারি মেশিনের সংখ্যা ১২ এবং তার সব কটি সচল নয়।

এনআইসিআরএইচের পরিচালক জাহাঙ্গীর কবির সার্বিক বিষয়ে বলেন, ‘আগের তুলনায় আরও ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় মেশিন রয়েছে খুবই কম। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রোগীদের ফিরিয়ে না দেওয়া।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘমল্লারের জবাবের পর ডাকসু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যা লিখলেন শশী থারুর

সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইলেন ফখরুল

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না জাবি শিক্ষক মৌমিতার

অনিয়মের অভিযোগ এনে জাকসু নির্বাচন কমিশন সদস্যের পদত্যাগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত