Ajker Patrika

জমি-বাড়িপ্রীতি পুলিশ কর্মকর্তাদের স্বজনদের

  • পুলিশ কর্মকর্তাদের স্ত্রীসহ স্বজনেরা কিনেছেন জমি, করেছেন বাড়ি।
  • সাভার ও আশুলিয়ায় ওসি থাকাকালে সাভারে ফ্ল্যাট কিনেছেন এক কর্মকর্তা।
  • বাধ্যবাধকতা থাকলেও কেনার আগে নেওয়া হয়নি অনুমোদন।
অরূপ রায়, সাভার (ঢাকা) 
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ার কাইচাবাড়িতে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) পেছনের প্রাচীর ঘেঁষে বেশ কিছু বহুতল ভবন। এগুলোর মধ্যে তিনতলা একটি ভবনের মালিক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এস এম বদরুল আলমের স্ত্রী মাসুমা খানম। ৬ শতাংশ জমির ওপর এই বাড়ি নির্মিত হয়েছে ২০১৪ সালে। জমি কেনা হয় ২০১৩ সালে। এস এম বদরুল আলম তখন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন।

শুধু এস এম বদরুল আলম নন, সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানায় কর্মকালীন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ও স্বজনদের নামে সাভার, আশুলিয়া এবং ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাট কেনা হয়। কারও কারও কেনা জমিতে বাড়িও উঠেছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা জমি ও বাড়ির তথ্য নিশ্চিত হতে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের পাশাপাশি সাভার ও আশুলিয়া সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে দলিল সংগ্রহ করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্য ও দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, এস এম বদরুল আলমের স্ত্রী মাসুমা খানমের নামে ২০১২ সালের মার্চে আশুলিয়ার পাথালিয়া ইউনিয়নের উত্তর রামেন্দ্রপুর মৌজায় ৩৩ শতাংশ, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ধামসোনা ইউনিয়নের গণকবাড়ি মৌজায় ৬ শতাংশ এবং একই বছরের ডিসেম্বরে ধামসোনার বাইপাইল মৌজায় সাড়ে ১৬ শতাংশ জমি কেনা হয়। দলিলগুলোতে ওই সাড়ে ৫৫ শতাংশ জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ৩০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তবে ওই সময়ের বাজারদর অনুযায়ী দাম প্রায় ৩ কোটি টাকা।

মাসুমা খানমের ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে গণকবাড়ি মৌজার ৬ শতাংশ জমিতে। স্থানীয় জানান, তখন ওই জমির বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৩০ লাখ টাকা। বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৩০ লাখ টাকা।

বাড়িটি দেখভাল করা মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘স্যার ও স্যারের স্ত্রী অনেক দিন ধরে দেশের বাইরে আছেন। আমি তাঁদের অবর্তমানে জমি ও বাড়ি দেখাশোনা করি। ভাড়া তুলে স্যারের কাছে পাঠাই।’

বিদেশে থাকায় এসব বিষয়ে মাসুমা খানম বা তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

পুলিশ কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামালের স্ত্রী খন্দকার শামীমা হাসানের নামে ২০১৩ সালে গণকবাড়ি মৌজায় ৭ শতাংশ, একই বছর পাথালিয়া ইউনিয়নের শকরান মৌজায় ৫ শতাংশ এবং ২০১২ সালে স্কুলপড়ুয়া ছেলে মাহিম মুরসালিমের নামে সাভার পৌর এলাকার ছোট বলিমেহের মৌজায় আড়াই শতাংশ এবং ২০১১ সালে একই মৌজায় বাবা আবু জাফর মিয়া ও ভাই তানভীর আহমেদের নামে ৫ শতাংশ জমি কেনা হয়। মোস্তফা কামাল তখন সাভার ও আশুলিয়া থানার ওসি ছিলেন। দলিলে এসব জমির ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ১৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। স্থানীয়দের মতে, তখন প্রকৃত বাজারদর ছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা।

গত বছরের ৫ আগস্টের আগে মোস্তফা কামাল কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় কর্মরত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তবে তাঁর বর্তমান কর্মস্থল জানা যায়নি। তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরও বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্টের পর মোস্তফা কামালের নামে একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্তাধীন। এ কারণে হয়তোবা তিনি সাবধানতা অবলম্বন করছেন। তাই তাঁকে মোবাইলে বা সরাসরি না পাওয়ারই কথা।

সাভার পৌর এলাকার পার্বতীনগরে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের একটি ভবনের নয়তলার ‘ডি’ নম্বর ফ্ল্যাটের মালিক পুলিশ পরিদর্শক এ এফ এম সায়েদ। সাভার ও আশুলিয়া থানার ওসি থাকাকালে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন। জানা গেছে, এমন ফ্ল্যাটের দাম প্রায় কোটি টাকা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে হত্যার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। তিনি তখন আশুলিয়া থানার ওসি ছিলেন। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপনে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

ওই ভবনের বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ পরিদর্শক এ এফ এম সায়েদ স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে তাঁরা অন্যত্র চলে গেছেন।

ধামরাই পৌরসভার ধানসিঁড়ি আবাসিক এলাকায় ১৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের আটতলা বাড়ির মালিক পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ভজন রায়ের স্ত্রী মনিকা সরকার। ওই জমি কিনে বাড়ি করার সময় ভজন রায় ধামরাই থানায় কর্মরত ছিলেন।

তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে ২০২২ সালে ধামরাই পৌরসভায় করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর এক পত্রে মনিকা সরকারের নামে ধানসিঁড়ি আবাসিক এলাকায় আটতলা বাড়ি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২০২৪ সালে আজকের পত্রিকাকে দেওয়া এক পত্রে জানানো হয়, মনিকা ধামরাইয়ে জমি কেনার এবং আটতলা বাড়ি নির্মাণের আগে তাঁর স্বামী সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী কোনো অনুমতি নেননি।

স্থানীয়রা জানান, জমি কেনাসহ এমন একটি বাড়ি নির্মাণে প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ হয়।

জানতে চাইলে ভজন রায় বলেন, ‘কিছু টাকা ঋণ করে আর কিছু টাকা বাবার (ভজন রায়ের শ্বশুর) কাছ থেকে নিয়ে আমার স্ত্রী জমি কিনে বাড়িটি নির্মাণ করেন। মোট খরচ আমার জানা নেই। তবে বাড়ি বা জমির পেছনে আমার কোনো টাকা খরচ হয়নি।’

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাভার শাখার সহসভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী, চাকরিকালে কোনো সরকারি কর্মচারী বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া আড়াই লাখ টাকার ওপরে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন না। তাঁর ধারণা, পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে এসব স্থাবর সম্পত্তি কেনার আগে বিধিমালা অনুযায়ী অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এখন তদন্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

যোগাযোগ করা হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ঢাকা জেলা কার্যালয়-২-এর সহকারী পরিচালক আরিফ আহমেদ বলেন, ‘সাভার, ধামরাই ও আশুলিয়া থানায় কর্মরত অবস্থায় পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনেছেন কি না, তা আমাদের জানা নেই। আমার জানামতে, কোনো অভিযোগও করেননি কেউ। তবে অভিযোগ পাওয়া গেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত