Ajker Patrika

চবির ১০ ছাত্রী বহিষ্কার: প্রশাসনকে চাপ দিতে ছাত্রনেতাদের বার্তা পাঠান সহকারী প্রক্টর

  • এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী প্রক্টরের ইন্ধনের তথ্য মিলেছে।
  • চাপ দিয়ে তদন্তে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ।
  • আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ হচ্ছে, দাবি দুই প্রক্টরের।
সাখাওয়াত ফাহাদ, ঢাকা 
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ২৩
চবির ১০ ছাত্রী বহিষ্কার: প্রশাসনকে চাপ দিতে ছাত্রনেতাদের বার্তা পাঠান সহকারী প্রক্টর

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে একটি ছাত্রী হলের সামনে ভাঙচুরকে কেন্দ্র করে ১০ জন নারী শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী প্রক্টরের ইন্ধনের তথ্য মিলেছে। অভিযোগ উঠেছে, সহকারী প্রক্টর নূরুল হামিদ কানন ও অধ্যাপক ড. মো. কোরবান আলী নারী শিক্ষার্থীদের শাস্তির দাবিতে প্রশাসনকে ‘চাপ দিতে’ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন।

কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। তাঁরা বলেছেন, ১০ নারী শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ও অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, ছাত্রী হলের সামনে গভীর রাতে মব তৈরি হলে বিভিন্ন প্রগতিশীল ও নারী অধিকারের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রীরাই প্রথমে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। জুলাই অভ্যুত্থানেও তাঁদের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। অভ্যুত্থানের পরও তাঁরা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকারের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের আধিপত্য বিস্তার এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার ত্বরান্বিত করতে নেপথ্যে কাজ করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক নেতা আজকের পত্রিকাকে অভিযোগ করে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠনের পরই নারী শিক্ষার্থীদের বিচার চেয়ে প্রশাসনকে চাপ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের প্রায় ২০ জনের বেশি নেতা-কর্মীর কাছে বার্তা পাঠান দুই সহকারী প্রক্টর।’ তবে বার্তাপ্রাপ্ত অধিকাংশই এতে সাড়া দেননি বলে জানান তিনি।

৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সহকারী প্রক্টরদের ‘প্রেসক্রিপশনে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন শিক্ষার্থী শেখ হাসিনা হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের সিট বাতিল ও তদন্ত সাপেক্ষে ছাত্রত্ব বাতিলের দাবিতে প্রক্টর অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন। পরে তাঁরা নারী শিক্ষার্থী কর্তৃক ছাত্র-সাংবাদিক আহত হওয়া ও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফকে অভিযোগপত্র দেন। অন্যদিকে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ ও হেনস্তার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে মানববন্ধন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।

কী ঘটেছিল ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে

বহিষ্কারের ঘটনায় ভুক্তভোগী, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা আজকের পত্রিকাকে জানান, রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২-এ ভাঙচুরের উত্তেজনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলের সামনে স্থাপিত ‘নৌকা’সদৃশ বসার স্থান ভাঙতে রাত সাড়ে ১১টায় ছাত্রী হলের সামনে ‘মব’ তৈরি হয়। এতে নারী শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং হলের নিচে নেমে আসেন। এ সময় অনেকেই ‘ঘরের’ পোশাকে ছিলেন, তাই সাংবাদিকেরা ভিডিও চিত্র নিতে চাইলে তাঁরা নিষেধ করেন। একপর্যায়ে এ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

বহিষ্কারের ঘটনায় ভুক্তভোগী এক নারী শিক্ষার্থী আজকের পত্রিকাকে বলেন, সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. কোরবান আলী ঘটনাস্থলে এসে ‘মবের’ পক্ষ নেন এবং নারী শিক্ষার্থীদের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’সহ নানা অশালীন ভাষায় গালাগাল শুরু করেন। এতে এক শিক্ষার্থী ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর গায়ে হাত তোলে। তাঁর ভাষা ব্যবহার ও আচরণে তিনি যে সহকারী প্রক্টর, তা অনেকেই বুঝতে পারেননি।

চাপ দিয়ে তদন্তে প্রভাব বিস্তার

৫ ফেব্রুয়ারি রাতের ঘটনা নিয়ে পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে আয়োজিত এক সভায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, সব হলের প্রভোস্ট ও হাউস টিউটর, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য এবং পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও একটি নিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি গঠনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী প্রক্টর নূরুল হামিদ কানন তাঁদের দলীয় নেতা-কর্মীদের তদন্ত কমিটি ও প্রশাসনকে ‘চাপ দিতে’ তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান। অন্যদিকে ঘটনায় ‘দায়ী’ হিসেবে চিহ্নিত করা ছাত্রীদের ছবি পাঠিয়ে ছাত্রসংগঠনের নেতাদের প্রক্টর ও প্রশাসনিক কার্যালয় ঘেরাওয়ের কথা বলেন অধ্যাপক ড. মো. কোরবান আলী।

৬ ফেব্রুয়ারি সহকারী প্রক্টর নূরুল হামিদ কানন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের শীর্ষপর্যায়ের এক নেতাকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান। সেই নেতা এবং সহকারী প্রক্টরের কথোপকথনে দেখা যায়, সহকারী প্রক্টর তদন্ত কমিটির প্রজ্ঞাপনটি পাঠিয়ে তাঁকে বলেন, ‘চাপ দাও, দাবি আদায় করো।’ এ ছাড়াও চিহ্নিত করা ছাত্রীদের ছবি পাঠিয়ে সহকারী প্রক্টর লেখেন, ‘এদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিতে প্রশাসনকে চাপ দাও। প্রক্টর অফিস ঘেরাও করো। বৈষম্যবিরোধীদের পক্ষে।’ এ ছাড়াও প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে হল থেকে যেন নারী ছাত্রীদের বের করে দেওয়া হয়, এ দাবি তোলার কথা বলেন সহকারী প্রক্টর নূরুল হামিদ কানন।

কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৩ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব রেসিডেন্স হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটি। এই কমিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেও সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. কোরবান আলী ১২ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের নারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের দাবি জানাতে বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিআরএফ ইয়ুথ ক্লাবের ব্যানারে মানববন্ধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সহকারী প্রক্টর নূরুল হামিদ কানন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ছাত্রসংগঠনের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয়। সে সময় যেহেতু ওই ঘটনা ঘটছিল, তাই সেটা নিয়েই তাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, হয় নাই তা বলছি না।’ অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কেউ এ ধরনের কথা বললে মনে করি আমাদের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।’

অভিযোগের বিষয়ে আরেক সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. কোরবান আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে তো আমি কিছু জানি না, আপনার কাছ থেকেই বিষয়টি জানলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার কয়েকজন ছাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করছে, কোন মেয়েরা আপনাকে ইয়ে করেছে, তাদের ছবি পাঠান, আমি বিভিন্ন মাধ্যমে আসা ছবিগুলো তাদের পাঠিয়েছি। ঘেরাওয়ের কথা বলার কোনো প্রশ্নই আসে না।’ ছাত্রসংগঠনের নেতারা তবে মিথ্যা অভিযোগ করছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তা তো অবশ্যই। এগুলো করার কোনো দরকার আছে আমার?’ নারী শিক্ষার্থীদের ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে অশালীন ভাষায় গালাগালের বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘আপনি ভিডিওতে যা শুনেছেন, তা ভুল শুনেছেন। আপনার শোনা ঠিক নেই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত