Ajker Patrika

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল: স্বজনের অপেক্ষায় এখনো পথ চেয়ে আছেন পাতিলে ভেসে আসা মুসলিম

সবুজ শর্মা শাকিল, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)
মুসলিম উদ্দিন। ছবি: আজকের পত্রিকা
মুসলিম উদ্দিন। ছবি: আজকের পত্রিকা

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াল সেই রাতের ঘটনার ৩৪ বছর পার হয়েছে। এখনো স্বজনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন ঘূর্ণিঝড়ে পাতিলে ভেসে আসা ৩৬ বছর বয়সী যুবক মুসলিম উদ্দিন। বর্তমানে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করছেন সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের জঙ্গল ভাটিয়ারী পাহাড়ের ভেতরে স্থাপিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে। প্রতিবছর এই দিন এলে স্বজন হারানোর বেদনায় ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। অশ্রুতে বুক ভাসালেও তিনি এখনো জানেন না তাঁর মা-বাবা কে কিংবা তাঁদের বাড়িঘর কোথায় ছিল।

শুধু মুসলিম উদ্দিন নন, স্মরণকালের ভয়াবহ সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কথা উপকূলের মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। ৩৪ বছর আগে ২৯ এপ্রিল সামনে এলে ভয়াল সেই ট্র্যাজেডির করুণ চিত্র ভেসে ওঠে চোখের সামনে। দিনটি এলেই উপকূলীয় এলাকার ঘরে ঘরে কান্না আর শোকের রোল ওঠে। ওই দিনের মধ্যরাতে আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সীতাকুণ্ডের সলিমপুর থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত ৯টি ইউনিয়ন। প্রায় ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগ ঝড় ও ৩০-৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে উপকূল পরিণত হয়েছিল বিরানভূমিতে।

এ সময় মারা যান এলাকার প্রায় ৭ হাজার মানুষ। আর নিখোঁজ হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার শিশু-নারী-পুরুষ। ক্ষতি সাধিত হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ। ভয়াল সেই রাতের ৩৪টি বছর পেরিয়ে গেলেও উপকূলের অবস্থা সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। এখনো এলাকার প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।

সেই দিনের কথা জানতে চাইলে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন মুসলিম উদ্দিন। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি দুই বছরের শিশু। তিনি বড় একটি পাতিলের ভেতরে করে ভেসে ভাটিয়ারী উপকূলে আসেন বলে স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন ভেসে আসা পাতিলের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনে জেলে সম্প্রদায়ের এক লোক তাঁকে উদ্ধার করেন। পরে তাঁকে ভাটিয়ারী বাজারের উত্তর পাশের তেলীবাড়ী এলাকার স্থানীয় এক মুসলিম পরিবারের কোলে তুলে দেন।

শিশুকালের সেই সময়ের স্মৃতি তাঁর মনে না থাকলেও ৭ থেকে ৮ বছর বয়সের স্মৃতি তাঁর বেশ মনে রয়েছে। আট বছর বয়সে যখন তাঁর পালক বাবার পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। তখন তিনি ভাটিয়ারী কাঁচাবাজারে ঘুরে ঘুরে পলিথিন (বাজারের ব্যাগ) বিক্রি শুরু করেন। পরে নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়িয়েছেন।

মুসলিম উদ্দিন আরও জানান, তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমানে সুখের সংসার করলেও নিজের পিতৃপরিচয়ের শূন্যতায় নীরবে কাঁদছেন তিনি। বর্তমানে তাঁর মা-বাবা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, জানেন না তিনি। তাঁদের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, এটাই সবচেয়ে বড় কষ্টের অনুভূতি তাঁর জীবনে।

কুমিরা, বাঁশবাড়িয়া, সোনাইছড়ি, ভাটিয়ারীসহ কয়েকটি উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা জানান, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের বন্যার পর থেকে গত ৩৪ বছরে উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে কয়েক শ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মিত হলেও তা কয়েক বছর না পেরোতেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে। এখনো এসব ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধে ভাঙন থাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

বাঁশবাড়িয়া এলাকার উপকূলীয় স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ৩৪ বছর পার হলেও এখনো সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় এলাকায় নির্মাণ করা হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। এখনো এই অঞ্চলের মানুষ ষাটের দশকের ভঙ্গুর বেড়িবাঁধের ওপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।

উপকূলীয় বাসিন্দারা আরও জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এবং পরবর্তীতে ১৯৯৪ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানির পর আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অর্থায়নে উপকূলীয় এলাকায় বিপুলসংখ্যক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। সীতাকুণ্ডের পৌর এলাকাসহ ৯টি ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকায় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র ৫৬টি।

সলিমপুর থেকে বাঁশবাড়িয়া উপকূলীয় এলাকায় দেখা গেছে, শিপ ইয়ার্ড নির্মাণ করতে গিয়ে ওই সব এলাকায় বনায়ন নেই বললেই চলে। গত পাঁচ-ছয় বছরে কুমিরা ও বাঁশবাড়িয়া উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন কেটে আরও ছয়টি শিপ ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। ওই সব এলাকায় বনায়নের কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। ১৯৯১ সালের মতো পুনরায় যদি এসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয়, তাহলে আরও ব্যাপক প্রাণহানিসহ সম্পদ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীতাকুণ্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে যে বেড়িবাঁধ আছে, সেটি ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কারণ ১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘোড়ামরা-কুমিরাসহ ৪ কিলোমিটার প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলোর ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা থাকায় সংস্কারও হচ্ছে না। নিয়মিত সাগরের পানি ঢোকে। ঝড়ে তা ভয়াবহ হতে পারে।

সীতাকুণ্ড উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. শামস্ জামিরুল জানান, উপকূলীয় এলাকার মানুষের তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তীতে যতগুলো আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও নির্মাণের সময় সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অধিকসংখ্যক লোক আশ্রয় নিতে পারে না।

সীতাকুণ্ড উপকূলীয় বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আলী রনি জানান, সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে সরাসরি থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধে ব্যাপক বনায়ন করা হয়। কিন্তু কিছু অসাধু চক্র উপকূলীয় বেড়িবাঁধ রক্ষায় লাগানো গাছগুলো রাতের আঁধারে কেটে সাবাড় করছে। ফলে গাছ উজাড়ে অব্যাহত মাটি ক্ষয়ের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ যেমন বিপন্ন হচ্ছে, তেমনি আবারও জলোচ্ছ্বাসের মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন উপকূলীয় এলাকাবাসী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত