Ajker Patrika

‘রেলর ভেতর কেন ওই আগে নজাইনতাম’

সৌগত বসু, কক্সবাজার থেকে 
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ২২: ১৫
‘রেলর ভেতর কেন ওই আগে নজাইনতাম’

‘আগে হন দিন রেলত নচড়ি। আজিয়াই পইলা চড়ির। হদিন ধরি রেল দেহির। রেলর ভেতর টিবি দেহির। রেলর ভেতর কেন ওই আগে নজাইনতাম।’ (এই প্রথম ট্রেনে চড়লাম। এর আগে কখনো চড়ি নাই। কয়েক দিন ধরে দেখেছি। ট্রেনের ভেতরে টিভি দেখি। এর আগে জানতাম না ট্রেনের ভেতর কেমন হয়)। 

কক্সবাজারে ট্রেন দেখে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছিল ১৪ বছর বয়সী মো. মারুফ। এই প্রথম সে সামনাসামনি ট্রেন দেখল। অবশ্য এর আগেও দেখেছে, তা টিভি বা মোবাইলে। 

মারুফের মত আরও শত শত তার বয়সী ছেলে মেয়েদের ভিড় ট্রেন জুড়ে। ট্রেনের বগিতে (কোচ) লাগানো টিভিতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারা। কেউ কেউ সিটে বসে সেলফি তুলছে। আবার কেউ বগির ভেতরে থাকা সবকিছু পরখ করে দেখছে। এ যেন হঠাৎ শহরে কোনো বিশেষ বস্তুর আগমন।

আজকের পত্রিকার প্রতিবেদকের ভাষ্য— দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে নিশ্চিত হলাম উদ্বোধনী ট্রেনটি কক্সবাজার থেকে আবার ঢাকা ফিরে যাবে। বাংলা নিউজ ২৪ এর সহকর্মী নিশাত বিজয় রেলের জনসংযোগ কর্মকর্তার কাছ থেকে আবার নিশ্চিত হলেন যে আমরা সেই ট্রেনে ঢাকা ফিরতে পারব। কিন্তু হাতে সময় আছে ঠিক ৫০ মিনিট। একটু আগেই প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ করে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিলাম। তড়িঘড়ি করে শেষ করে হোটেলে ফিরে এলাম। এরপর হোটেলের সব বিল দিয়ে ছুটলাম স্টেশনের দিকে। গত দুই দিন ধরে বাইরে থেকেই দেখেছি কক্সবাজারের নান্দনিক ঝিনুক স্টেশন। সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে দুপুর ৩টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম স্টেশন। 

ঝিনুকে ঢোকার আগে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল! দৌড় দিলাম। ১৯টা নতুন বগি (কোচ) নিয়ে একদম নতুন ঝকঝকে একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। খারাপ লেগেছে ঝিনুকের ভেতরে যেতে পারেনি। একটি সূত্র জানাল ছয়তলা ভবনের স্থাপনায় কাজ শেষ হয়েছে মাত্র দুই তলার। আজ উদ্বোধন উপলক্ষে টানা কয়েক দিন তড়িঘড়ি করে দোতলা পর্যন্ত কাজ শেষ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দোতলা পর্যন্ত ঘুরে দেখেছেন। বাকি কাজ শেষ হতে প্রায় ৩ মাস লেগে যাবে। তবে ট্রেন চালু হলে তাতে কোনো প্রভাব পড়বে না। 

এদিকে এই ট্রেনটি একটু আগে উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ট্রেনটির রামু স্টেশনে গিয়েছিল। ফিরে এসেছে আবার কক্সবাজার স্টেশনে। এটি আবার বিশেষ ব্যবস্থায় যাবে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ট্রেনের প্রতিটি বগি ছিল ভর্তি। তখন মনে হচ্ছিল যেন এটি স্থানীয় মানুষদের দখলে। যেন কক্সবাজার থেকে নিয়মিত ট্রেনে ঢাকা যাবে সবাই। তবে সাড়ে তিনটা বাজলেও ট্রেন ছাড়ার নাম নেই। আস্তে আস্তে বোঝা গেল এটি যেহেতু বিশেষভাবে ঢাকা পৌঁছাবে তাই কিছু কারণে সময় নিচ্ছে। সিগন্যালিং, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসার জন্য সময়। ট্রেনের প্রতিটি বগিতে ভাগ হয়েছেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তারা এই ট্রেনে চট্টগ্রাম ও ঢাকা ফিরবেন। 

কোরিয়ান কোচ এই ট্রেনে ১৪টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগি রয়েছে। আসনগুলো অত্যাধুনিক। সুইচের মাধ্যমে চেয়ার হেলানো যায়। পাশেই ফ্যান ও লাইটের আলাদা সুইচ। আসনের সঙ্গে রয়েছে টেবিলের মত জায়গা। যেখানে কোনো কিছু রাখা যাবে। মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার জন্য আছে আলাদা পয়েন্ট। বগির সঙ্গে থাকা দরজাগুলো স্বয়ংক্রিয়। যদি ঠিক ভাবে না লাগানো হয় তবে শব্দ করে জানান দেয়। 

বিকেল ৫টা ৪ মিনিটে হুইসেল বাজিয়ে কক্সবাজার স্টেশন ত্যাগ করে নতুন এই নাম না দেওয়া উদ্বোধনী ট্রেনটি। তখন স্টেশনে থাকা মানুষের মধ্যে তৈরি হয় উচ্ছ্বাস। সবার আগ্রহ ছিল কবে থেকে নিয়মিত এই পথে ট্রেন যাত্রা শুরু হবে তা নিয়ে। কক্সবাজার স্টেশন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আঁধার ভর করে চারপাশে। প্রায় ৫০ মিনিট টানা চলার পর ধীর গতি পেলে বাইরে থেকে হই হুল্লোড়ের শব্দ আসে। থামে ট্রেন। দরজার কাছে গিয়ে দেখা যায় নতুন একটি স্টেশন। এটির নাম ঈদগাঁ স্টেশন। স্থানীয়দের ভিড় এই স্টেশনের দুপাশে। কিশোর বয়সী ছেলেদের আগ্রহ বেশি। তারা ট্রেন দেখেনি। একবার উঠতে চায়। তবে সেই সম্ভাবনা না থাকায় ট্রেনে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থেকে নিজেদের কৌতূহল মিটিয়ে নেয়। তাদের চোখে মুখে ট্রেন নিয়ে উচ্ছ্বাস। ট্রেনটি আবার চলতে শুরু করে। চিরায়ত ঝকঝক শব্দে ট্রেনটি ছুটে চলে চট্টগ্রামের পথে। হয়তো আবার কোথাও একটু দাঁড়াবে, উচ্ছ্বাসের শব্দ পাওয়া যাবে। ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে এই উচ্ছ্বাস অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত