Ajker Patrika

মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহশালায় মুক্তিযুদ্ধই উপেক্ষিত

শাকিলা বিবি, সিলেট
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহশালায় মুক্তিযুদ্ধই উপেক্ষিত

তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নির্মিত ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহশালা ও পাঠাগার’ উদ্বোধনের কথা রয়েছে এ মাসেই। কিন্তু প্রায় ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সংগ্রহশালা নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনা। নামে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহশালা ও পাঠাগার হলেও মুক্তিযুদ্ধই সেখানে উপেক্ষিত। শহীদ মিনারের ইতিহাস যেখানে থাকার কথঅ সেখানে রয়েছে সিলেটের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের ছবি শুধু। মানা হয়নি শহীদ মিনারের মূল নকশাও। এ নিয়ে শহীদ মিনারের মূল নকশার সঙ্গে জড়িত শিল্পীরাসহ স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নির্মাণ করা হচ্ছে এক হাজার বর্গফুটের এ ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহশালা ও পাঠাগার’। সিলেট সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে নির্মিয়মাণ এ সংগ্রহশালায় থাকার কথা ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইতিহাস। স্থান পাওয়ার কথা সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত দুর্লভ বিভিন্ন ছবি ও মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামের সংগ্রহ। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই সংগ্রহশালা ও পাঠাগারকে সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের একটি আকর হিসেবে গড়ে তোলার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

সিলেটের এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নতুন করে নির্মিত হয় ২০১৪ সালে। ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে একটি মিছিল থেকে শহীদ মিনার ভাংচুর করা হয়। নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের সময়ই এর নিচে (আন্ডারগ্রাউন্ডে) তিন হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও আলোকচিত্র সম্বলিত একটি সংগ্রহশালা ও পাঠাগার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পুনর্নির্মিত শহীদ মিনার উদ্বোধন হলেও নানা অজুহাতে আটকে যায় সংগ্রহশালা ও পাঠাগার নির্মাণের কাজ, যা এখন শুরু হয়েছে। সংগ্রহশালা ও পাঠাগার নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার সহযোগিতায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিল সিটি করপোরেশন। এর নকশা তৈরি করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক শুভজিৎ চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন চিত্রশিল্পী ইসমাইল গনি।

সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন। স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন, মূল নকশার সঙ্গে মিল না রেখেই সংগ্রহশালাটি তৈরি করা হচ্ছে। নতুন সংগ্রহশালা নির্মাণে মূল নকশা অগ্রাহ্য করা হয়েছে উল্লেখ করে ইসমাইল গনি বলেন, ‘নকশার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালার মিল নেই। এ নিয়ে হওয়া প্রথম সভায় বলা হয়েছিল সিলেটের মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ মিনারের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় থাকবে এতে। কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে এটি লোক–কবি ও পর্যটন সম্পর্কিত সংগ্রহশালা। এই বিষয়ে সংগ্রহশালা হতেই পারে। কিন্তু এটি এখানে হওয়ার কথা ছিল না। এখানে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত চিঠি, পোস্টার, ছবি, অস্ত্র, পোশাক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ের একটি পাঠাগার থাকার কথা ছিল। কিন্তু এই সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত বস্তুর অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৯৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা ব্যয় ধরে শুরু হয় সংগ্রহশালাটির নির্মাণকাজ। কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি এটি উদ্বোধনের সংবাদ দিয়েছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র। একই সঙ্গে স্বাধীনতার মাসে এটি উন্মুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। মেয়রের দেওয়া এমন খবরে আশান্বিত হয়েছিলেন সিলেটের মানুষ। কিন্তু মূল নকশার সঙ্গে মিল না রেখে কাজ করায় এখন হতাশ সিলেটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষজন।

মূল নকশার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সংগ্রহশালায় ঢুকলেই সামনে যে দেয়াল, সেখানে শহীদ মিনারের ইতিহাস সম্পর্কিত একটি লেখা। সামনের দেয়ালে মোট ছয়টি দেয়ালিকায় লাগানো মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ ছবি, অস্ত্র, রেডিওসহ মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম। রয়েছে এর নিরাপত্তা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত স্থান। রয়েছে বই পড়ার জন্য চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা। এমনকি মাঝখানে থাকা খুঁটিগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ছবি সাঁটা।

মূল নকশায় যা–ই থাক, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সরেজমিনে দেখা যায়, শুরুতেই হাসনরাজা, রাধারমণ ও শাহ আব্দুল করিমের ছবি সাঁটা রয়েছে দেয়ালিকার স্থানটিতে। কোনো ছবির সঙ্গেই নেই পরিচয়লিপি। নেই কোনো বই পড়ার জন্য কোনো টেবিল–চেয়ার। কয়েকটি কাঠের টুকরো জোড়াতালি দিয়ে বানানো হয়েছে ছয় দেয়ালিকায় ঝুলছে পর্যটন স্থানের দৃশ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যেসব চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে, সেগুলোতেও নেই কোনো বর্ণনা।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহশালা ও পাঠাগারের অনেক কাজ এখনো বাকি। এটি উন্মুক্তের আগে সব হবে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অনেক ছবি লাগানো হয়েছে। আর ডিজাইনের সঙ্গে মিল না থাকার কথা নয়। আমি প্রয়োজনে সকলকে নিয়ে বসে আলোচনা করে এর সমাধান করব।’ তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ। তাই এর কাজে কোনো ত্রুটি থাকলে অবশ্যই তা সংশোধন করা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত