Ajker Patrika

কাফকার ছবি ছবির কাফকা

সৈকত দে
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২২, ১৬: ০৮
কাফকার ছবি ছবির কাফকা

ফকা-সাহিত্যের অধিকাংশ লেখা লেখকের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি, আমরা জানি। মানুষের ধূসর একাকিত্ব এবং তীব্র বিমূর্ততাকে লিপিবদ্ধ করে গেছেন জীবনভর। যন্ত্রনির্ভরতাকাতর এই নতুন পৃথিবীর বীভৎস, রূঢ়, কর্কশ বাস্তবতা অসম্পাদিত আকারেই আমরা তাঁর লেখাপত্রে দেখি।

‘দ্য মেটামরফোসিস’ লেখায় যেমন দেখি গ্রেগর সামসা রাতারাতি এক দৈত্যকার তেলাপোকার রূপ পরিগ্রহ করে। ‘দ্য ট্রায়াল’-এ আমরা দেখি, জোসেফকে অসংজ্ঞায়িত এক অপরাধের দায়ে প্রায় উন্মাদ বিচারব্যবস্থার কাছে দণ্ডিত। গল্পের পর গল্পে, কাফকা চরিত্ররা নিরাবয়ব আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অব্যবস্থা, লজ্জা এবং অপরাধবোধের গহন দ্বৈত আক্রমণে বিদ্ধ হতে থাকে।

দ্য থিংকার, ১৯১৩মৃত্যুশয্যায়, মনোদৈহিক জটিলতায় জর্জরিত কাফকা বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে বলেছিলেন, সব লেখা পুড়িয়ে ফেলতে। ব্রড প্রিয়তম বন্ধুর কথা না রাখায় বিশ্বসাহিত্য এমন এক লেখককে পেল, যাকে কেন্দ্র করে এখনো প্রায় প্রতিদিন একাধিক গ্রন্থ বিশ্বজুড়ে প্রণীত হয়ে চলেছে। উপন্যাস আর ছোটগল্পের বাইরে ব্রড প্রকাশ করেন দিনপঞ্জিও। এই দিনপঞ্জিতে কাফকা আনমনা আঁকিবুঁকি করেছেন, কলমের নানা রকম আঁচড় দিয়েছেন। আমাদের অনেকের মনে পড়ে যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি চিত্রের শুরুর দিনগুলো–যখন অন্য মনস্ক কলমের স্পর্শ, বানান শুদ্ধির প্রয়াসজনিত টানের সমারোহ কাগজের অক্ষর মধ্যস্থ শূন্যতায় জাগিয়ে তুলতে পারত মানুষের, জীবজন্তুর বা লতাপাতার মুখ। তবে, প্রকরণগত দিক থেকে চিন্তা করলে কাফকা আর রবীন্দ্রনাথ একেবারেই বিপরীত মেরুর। কাফকার কলমটানে আমরা তাঁর পাণ্ডুলিপির অক্ষরের সন্ততি সমাবেশের ধরনেই তীক্ষ্ণতা দেখি, ছবিগুলোর তীব্র রেখায় নিজের ওপর, সময়ের ওপর সর্বোপরি রাষ্ট্রের ওপর এক প্রচণ্ড রাগ চিত্র উপভোক্তার চোখ এড়াতে পারে না। পরবর্তীকালে, এসব চিত্রের বেশির ভাগ লেখকের নিজস্ব গ্রন্থের মলাট সৃজনে ভূমিকা রেখেছে।

হর্স অ্যান্ড রাইডার, ১৯০৯-১০‘দ্রুত, মিনিমালিস্ট চলন রেখা সমগ্রের, যা চিত্রকরের গদ্যভাষার মতোই মরিয়া’—মন্তব্য করেন ফিলিপ মার্টিগান, ‘আমার প্রবল বিস্ময় জাগে যখন দেখি কেমন করে এই সব সহজ সাবলীল টান, কবজির এই সব কারিকুরি এমন এক পরিস্থিতি ধারণ করে, যা থেকে বহুদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লেখকেরাও শিখতে পারেন কিছু একটা।’

গুস্তাভ জানুশ ‘কনভারসেশনস উইথ কাফকা’ বইয়ে আমাদের জানিয়েছেন, কাফকার নিমগ্ন আঁকিবুঁকির মাঝখানে তাঁর উদয় ঘটলে কী ঘটত–কাফকা বন্ধু জানুশকে দেখে তৎক্ষণাৎ সদ্য আঁকা ছবি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলতেন, যাতে কারও দৃষ্টির গোচরে থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এমন বেশ কয়েকবার ঘটার পর, কাফকা শান্ত হয়ে বন্ধুকে নিজের আঁকা ছবি দেখতে দিলেন।

ফেন্সিং, ১৯১৭সীমাহীন বিস্ময়ে অভিভূত হন কাফকার সান্নিধ্যে থেকে আন্তরিক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী বন্ধু জানুশ। জানুশ বলেন বন্ধুকে, ‘এই সব আমার সামনে তোমার তো লুকোনোর দরকার নেই বন্ধু। কী অপূর্ব নিষ্পাপ স্কেচ এগুলো!’

 আর তখন, আমরা ‘কনভারসেশনস উইথ কাফকা’ থেকে তুলে দিতে পারি, ‘কাফকা শান্তভাবে মাথা নেড়ে জানাতেন, দূর! তা নয়–তারা যেমন দেখাচ্ছে, অতটা নিষ্পাপ নয়। এই ছবিগুলো হচ্ছে আমার এক গহন কাঙ্ক্ষার চিত্ররূপ, অবশেষ। এ কারণেই আমি তোমার কাছে এই সব লুকোতে চেয়েছি। এটি নিছক কাগজের ওপর আঁকা নয়, অন্তর্গত বাসনার চিত্ররূপ এসব। আমি চিরকাল অঙ্কনের দক্ষতা অর্জন করতে চেয়েছি, ধরতে চেয়েছি অধরা দ্রষ্টব্যকে—এই হচ্ছে আমার একমাত্র প্যাশন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত