সুদেব চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।
সুদেব চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২১ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫তৌহিদুল হক

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২১ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২১ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২১ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫