Ajker Patrika

ডি এইচ লরেন্সের বাড়ির খোঁজে

আরিফ আবেদ আদিত্য
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২২, ১৭: ৩০
ডি এইচ লরেন্সের বাড়ির খোঁজে

নটিংহ্যাম শহরে নেমেই মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকে ৮/এ, ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট, ইস্টউড। আগের রাতে শেফিল্ডে ছিলাম সহকর্মী মামুনের বাসায়। রাতেই দুজনে ট্রেনের টিকিট কেটে রাখি নটিংহ্যামে যাওয়ার। দূরত্ব বেশি না, মাত্র এক ঘণ্টার পথ। সকাল ৯টার ট্রেন ধরব বলে আধা ঘণ্টা হাতে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু বিধি বাম, শেফিল্ড শহরের খাঁড়া-ঢালু পথ বেয়ে রেলস্টেশনে যেতে না যেতেই মাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন ছেড়ে গেল। দুজনের তখন   আফসোস, আরও এক ঘণ্টা পর অন্য ট্রেনের অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।

প্রথম সেমিস্টার শেষ করে ২২ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করি। অক্টোবরে বিলাতে আসার পর পড়াশোনার চাপ ও অসহনীয় ঠান্ডায় নিজ শহর ছেড়ে বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রথমে গন্তব্য ঠিক করি ম্যানচেস্টার, সেখান থেকে বিটলসের শহর লিভারপুল; তারপর শেফিল্ড ঘুরে নটিংহ্যাম—শেষে লন্ডন হয়ে নিজ শহর ক্যান্টাবরি প্রত্যাবর্তন। এই পরিকল্পনা মোতাবেক ক্যান্টাবরি ওয়েস্ট স্টেশন থেকে ম্যানচেস্টারের টিকিট কাটি। আগেই স্টুডেন্ট কার্ড দিয়ে রেল কার্ড করে রেখেছিলাম বলে রেলে ভাড়া তিন ভাগের এক ভাগ কম হয়। ইংল্যান্ডে রেলের ভাড়া আর বিমানভাড়া প্রায় কাছাকাছি। অনেক সময় বিমানভাড়া রেলের চেয়ে কম হয়। তবে এসি বাসের ভাড়া সবার নাগালে—স্বল্প খরচ। যাতায়াতে ট্রেন সবচেয়ে আরামদায়ক। যাই হোক, এবার ইংল্যান্ডের কয়েকটি শহর ভ্রমণের গল্প করা যাক।

ডি এইচ লরেন্সের বাড়ির পাশের গলি। ছবি: লেখকের সৌজন্যেযখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, হলুদ মলাটের একটা অনুবাদ বই, বিশ টাকা দাম ছিল হয়তো, প্রায়শই নীলক্ষেতে ফুটপাতে দেখা মিলত। কেমন একটা নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ গন্ধ মিশ্রিত আবহ কাজ করত বইটাকে ঘিরে। তখন প্রথম বর্ষের দিকে বয়ঃসন্ধি পেরিয়েছি মাত্র—বইটার নাম ও প্রচ্ছদের মধ্যেই কেমন যেন একধরনের ‘নিষিদ্ধের’ প্রতি গোপন আকর্ষণ কাজ করত। আবার সামাজিক ট্যাবুও মাথার মধ্যে বিরাজ করত। ফলে নীলক্ষেতের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে বইটি হাতে নিয়ে সন্তর্পণে উলটে-পালটে দেখতাম আর মনের ভেতরে অজানা উত্তেজনা বোধ করতাম—অবচেতন মনে কাজ করত, না জানি কী আছে এর ভেতরে!

 

নিষিদ্ধ বই বা ম্যাগাজিনগুলো তখন ছেলেদের হলে পালাক্রমে পড়া হতো। একজনের পড়া শেষ হলে আরেকজন নিয়ে যেত। বলছি সেই বছর পনেরো-বিশ আগের কথা। তখন কিছু লেখকই ছিলেন, যাঁরা উদ্ভিন্ন যৌবন বা নিষিদ্ধ রোমাঞ্চকে উপলক্ষ করে লিখতেন। বইয়ের নামগুলোও ছিল চমকপ্রদ। যায়যায়দিনের বিশেষ সংখ্যাগুলো (যেমন শাড়ি সংখ্যা) ছিল তখন তুমুল জনপ্রিয়। নব্বইয়ের দশক এবং একুশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত সাহিত্যের একশ্রেণির পাঠক তৈরি হয়েছিল এই আপাতত গোপন রোমাঞ্চ আস্বাদন অনুরাগী।

ডি এইচ লরেন্সের বাড়িতে যাওয়ার ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের ফলক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

যাই হোক, একদিন বইটা কিনে টুপ করে ব্যাগে ভরে নিই। সেই হলুদ মলাটের বইটি ছিল ডি এইচ লরেন্সের (১৮৮৫-১৯৩০) ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’। এসব বই প্রকাশ্যে বহন করাও যেন অস্বস্তিকর। কারণ, যদি কেউ দেখে ফেলে! রোমাঞ্চের জায়গা থেকে বইটি পড়েছি ঠিকই, কিন্তু তখন জানতাম না এই বইয়ের লেখক বিশ্বসাহিত্যে উপন্যাসের ধারায় আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। সাহিত্য যেহেতু মানুষের জীবনকেই অনুকরণ করে, সেহেতু মানুষের জৈবিকতা উপেক্ষা করার উপায় নেই। মানুষের জীবনে ওতপ্রোতভাবে যৌনতা জড়িত—স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক। ডি এইচ লরেন্স মানুষের অন্ধকার আদিম প্রবৃত্তিকে এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি শ্রেণিসংগ্রামকে। আধুনিক উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো সমাজের প্রকাশ্য ও গোপন সব ক্রিয়াকলাপকে নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহভাবে তুলে ধরা। তাই লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ প্রকাশের পর সাহিত্যের শ্লীলতা ও অশ্লীলতা প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছিল। তবে শিল্প-সাহিত্যের চেয়ে সামাজিক শ্রেণিবিভাজন তুলে ধরে লরেন্স ব্রিটিশ সমাজকাঠামোকে ভেঙে দিয়েছিলেন এই উপন্যাসের মাধ্যমে। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে উঁচু শ্রেণির সঙ্গে নিচু শ্রেণির কোনো সম্পর্ক হতে পারে না—না মানসিক, না দৈহিক। ইংল্যান্ডের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় অত্যন্ত কঠোর ও রক্ষণশীল মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন এই উপন্যাসের মাধ্যমে। লরেন্স ব্রিটিশ রক্ষণশীল সমাজকে আঘাত করেছিলেন। ফলে দেখা যায়, ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ ইতালিতে ১৯২৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও ইংল্যান্ডে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ ছিল ৩২ বছর; পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশেই এটি প্রায় ২ লাখ কপি বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, এ সময় বিশ্বব্যাপী এটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হতে থাকে—বাংলাদেশেও তখন ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ সহজলভ্য হয়। অথচ ডি এইচ লরেন্সের জীবিতকালে সর্বশেষ প্রকাশিত হয়েছিল এই গ্রন্থ। যদিও এই উপন্যাসের থেকেও তাঁর অন্যান্য লেখা সমসাময়িক লেখক ও সমালোচকদের কাছে অধিক সমাদৃত ছিল। যেমন : ‘সন্স অ্যান্ড লাভারস’, ‘দ্য রেইনবো’, ‘উইমেন ইন লাভ’ ইত্যাদি।

বিখ্যাত ৮/এ বাড়ির প্রবেশদ্বার, যেখানে ডি এইচ লরেন্স জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সাহিত্যে ডি এইচ লরেন্সের অতি রগরগে বয়ন বা প্রথাবিরোধী সম্পর্ককে বিষয়বস্তু করার পেছনে কারণ ছিল তাঁর স্বকাল ও স্বসমাজের প্রতি তীব্র প্রতিবাদ ও শ্লাঘাস্বরূপ। অন্যদিকে, ঔপনিবেশিক শাসনে পিষ্ট পরাধীন বাংলার সমাজব্যবস্থা ব্রিটিশ আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সমান্তরাল ছিল না। ফলে ‘আধুনিক’ বাংলা সাহিত্যের পথ নির্মাণে বাংলার সমাজকাঠামো কতটা প্রস্তুত ছিল, তা প্রশ্নসাপেক্ষ বৈকি! কারণ, ইংল্যান্ডের প্রাক শিল্পবিপ্লব থেকে শিল্পবিপ্লব যুগে প্রবেশের সময় যে শ্রেণিসংগ্রাম ব্রিটিশ সমাজে দেখা গিয়েছিল, ডি এইচ লরেন্স তা-ই বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। অথচ পূর্ব বাংলায় তেমন কোনো সমাজ রূপান্তরের বিপ্লব পরিলক্ষিত হয় না। অথচ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা অনুকরণ হতে দেরি করেনি। যদিও ‘আধুনিক’ প্রপঞ্চের ধারক লেখকদের অনেক সমালোচক সময়ের চেয়ে অগ্রগামী চিন্তক হিসেবে আখ্যা দিতে চান। কিন্তু সমাজ ও সাহিত্য যদি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ধরা হয়, তবে এই বক্তব্যে ফাঁক থেকে যায়।

বাড়ির দেয়ালে লাগানো ডি এইচ লরেন্সের জন্মের বৃত্তান্ত। ছবি: লেখকের সৌজন্যেযাই হোক, ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’-এর পর এই ধারার বাংলা ভাষায় রচিত উপন্যাসগুলো পড়া শুরু করি। একে একে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’, বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’, সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’, মাহবুব-উল আলমের ‘মফিজন’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘সত্যের মতো বদমাশ’ ইত্যাদি নিষিদ্ধ(!) উপকরণে সন্নিবিষ্ট বই পড়া হয়ে যায়।

কোনায় অবস্থিত ডি এইচ লরেন্সের বাড়ি। ছবি: লেখকের সৌজন্যেডি এইচ লরেন্সের বাড়ি খোঁজার গল্পে ফিরে আসা যাক। আমরা পরের ট্রেনেই লরেন্সের জন্ম শহরে চলে আসি। এখানে নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কয়েকজন সহকর্মী পিএইচডি গবেষণারত আছেন। তাঁদের অপেক্ষায় রেখে নটিংহ্যাম রেলস্টেশনে নেমেই ট্রামে টিকিট কেটে শহরের 'আপার পার্লামেন্ট স্ট্রিট' নামক স্থানে চলে আসি। এই জায়গা থেকে রেইনবো বাসে করে ৪০ মিনিটে চলে যাই ৮/এ, ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট, ইস্টউড, যে বাড়িতে ডি এইচ লরেন্স জন্মেছিলেন।

নটিংহ্যামশায়ারের ইস্টউড ছোট্ট ছিমছাম শহর। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় কয়লাশ্রমিকদের আবাস ছিল এই এলাকা। ইংল্যান্ডের প্রাক্‌-শিল্পবিপ্লবের সাক্ষী হয়ে আছে এই শহর। বাস থেকে নেমে গুগল ম্যাপ ধরে কয়েক মিনিট হাঁটতেই পেয়ে যাই লরেন্সের বাড়ি। নীলক্ষেতে দেখা একটি বইয়ের লেখকের বাড়ি খুঁজে পাওয়া যে কত আনন্দের, তা বলে বোঝানো যাবে না। মূল রাস্তা থেকে নেমে অপর পাশে হাতের ডান দিকে এগোতেই কিছুটা ঢালু পথ, অনেকটা গলির মতো। এই রাস্তার মাঝামাঝি আরেকটি গলির কোনায় লাল ইটের রঙে দাঁড়িয়ে আছে সেই ৮/এ বাড়িটি। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। এখান থেকে সোজা সামনে এগিয়ে গেলে ঢালু পথ একেবারে নেমে গেছে নিচে পাহাড়ের গোড়ায়।  সেখানে উপত্যকার মতো পাহাড়ি ঝিড়িপথ, জনমানুষশূন্য বনবনানী। সুদূরে তাকালেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারি আর ঘন অরণ্য। বাড়ির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখে ভেতরের প্রবেশদ্বারের চৌকাঠে বসে বিশ্রাম নিই কিছুক্ষণ। বর্তমানে এটি লেখকের নামে স্মৃতি জাদুঘর করা হয়েছে।

ডি এইচ লরেন্সের বাড়ির পেছনে ঢালু রাস্তা ধরে দূরে অরণ্যে আচ্ছাদিত পাহাড়। ছবি: লেখকের সৌজন্যেডি এইচ লরেন্স এই প্রাকৃতিক পাহাড়ঘেরা পরিবেশেই বেড়ে উঠেছিলেন। কয়লাখনি ও শ্রমিক অধ্যুষিত নটিংহ্যামশায়ারের এই জীবন ডি এইচ লরেন্সের ততটা সুখকর ছিল না। মাত্র ষোলো বছর বয়সে এই শহর ছেড়ে যাওয়ার পর বাকি জীবন কেটেছে বোহেমিয়ান। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় যাযাবর জীবন কেটেছে তাঁর। শারীরিক অসুস্থতা ছিল নিত্যসঙ্গী। যেখানেই যান না কেন, শৈশবের শহর নটিংহ্যামশায়ারকে তিনি ভুলতে পারেননি। তাঁর সাহিত্যিক জীবনকে তুমুল প্রভাবিত করেছে এই শহর। ফলে লরেন্সের অধিকাংশ উপন্যাসে পাওয়া যায় এই শহরের উপভাষা ও প্রতিচ্ছবি। শান্ত-নিরিবিলি ছোট্ট মহল্লার সেই ঢালু পথ ধরে দূরের অরণ্যের দিকে নেমে গেলাম কিছুটা। মনে মনে ভাবছিলাম, লরেন্সও কি এই রাস্তা ধরে হাঁটত একসময়? হয়তো! হয়তো না! হয়তো!

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

উত্তরায় জুলাই রেভেলসের দুই সদস্যকে কুপিয়ে জখম

নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে: তিন দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

এলাকার খবর
Loading...