Ajker Patrika

নিঃসঙ্গ নজরুল মঞ্চ এবং...

খান মুহাম্মদ রুমেল
নিঃসঙ্গ নজরুল মঞ্চ এবং...

বইমেলার ভিড়, বইমেলার জৌলুশ—পুরোটাই এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে। অথচ মেলা হয় বাংলা একাডেমি চত্বরেও। মূলত জায়গার অভাবে মেলা বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এখন সৃজনশীল প্রকাশকেরা সব স্টল প্যাভিলিয়ন নিয়ে বসেন মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে।

যত দূর মনে পড়ে ২০১৪ সাল থেকে মেলার পরিধি বেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত ঠেকেছে। এর আগে পর্যন্ত বাংলা একাডেমি চত্বর ঘিরে ঠাসাঠাসি করে বসতেন প্রকাশকেরা। মনে আছে মেলায় ঢোকার জন্য তখন বাংলা একাডেমির দক্ষিণ দিকের গেট ব্যবহার হতো। আর বের হওয়ার জন্য উত্তর পাশের অগ্রণী ব্যাংক লাগোয়া গেটটি ব্যবহার হতো।

বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের উত্তর পাশে একটি বটগাছ। লালচে রঙের টাইলসে বাঁধানো গাছের গুঁড়ি। কাজী নজরুল ইসলামের একটি ভাস্কর্য। এই নিয়ে নজরুল মঞ্চ। মেলার সময় নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য ব্যবহার হতো নজরুল মঞ্চ। মেলার পুরোটা সময় ভীষণ ভিড় লেগে থাকত এই নজরুল মঞ্চ ঘিরে। লেখক পাঠক দর্শনার্থীরা মিলে ব্যাপক আড্ডা জমাতেন নজরুল মঞ্চের চারপাশ ঘিরে। বর্ধমান হাউসে ঢোকার সিঁড়িতেও বসতেন বহু মানুষ।

গতকাল মঙ্গলবার বইমেলার চতুর্থ দিনে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হই বাংলা একাডেমি চত্বরে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বহু মানুষের শোরগোলে মুখরিত চারপাশ, আর বাংলা একাডেমি অংশ তখন নীরব নিথর। এই অংশে মূলত বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা সরকারি বিভিন্ন প্রকাশনা এবং কিছু পত্রিকার স্টল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভিড় নেই। এমনটাই হয়ে আসছে গেল বেশ কয়েক বছর ধরে। ধীরে হেঁটে গিয়ে বসি নজরুল মঞ্চের বাঁধানো বেদিতে। মাথার ভেতর স্মৃতিরা ভর করে।

এক সময় মেলার দিনগুলোতে কি ভীষণ ব্যস্ততা ছিল। কত কত গুণী লেখক প্রকাশকের আনাগোনায় রঙিন হয়ে থাকত এই প্রাঙ্গণ। সেই সময় প্রায়ই দেখা যেত মেলার মাঠ ধরে আয়েশি ভঙ্গিতে হাঁটছেন হুমায়ুন আজাদ। সব সময় তাঁকে ঘিরে থাকত ৭–৮ জনের একটি দল। সেই দলে একবার আমিও ভিড়েছিলাম। তখন আমি কলেজ পড়ুয়া কিশোর। শরীরে মফস্বলী গন্ধ। উচ্চারণে গেঁয়ো জড়তা। মেলায় গেছি কয়েক বন্ধুর সঙ্গে। এক বন্ধু দেখায়— ওই দেখ হুমায়ুন আজাদ। হেঁটে হেঁটে কথা বলছেন তিনি। আর তাঁর পেছনে কিছু তরুণ লেখক।

আমার এক বন্ধু অটোগ্রাফের জন্য খাতা বাড়িয়ে দেয়। দেখাদেখি আমিও। হুমায়ুন আজাদ আমার নাম জিজ্ঞেস করেন। জানতে চান কোথায় পড়ি। কলেজছাত্র শুনে প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন। বলেন—তোমরা তো অনেক ছোট। আমার কোনো বই পড়েছ?

— পড়েছি স্যার। লাল নীল দীপাবলি।

— আর কিছু পড়োনি?

— ‘‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না”। আর পড়েছি ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’।

এরপর আর কি কথা হয়েছিল মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে— একপর্যায়ে কেউ একজন তাঁর হাতে একটা বই তুলে দেন। আর সেই লেখকের হাত থেকে বইটা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন— তুমি আবার কবিতা লেখা শুরু করেছ! খুবই ভালো! কে সেই কবি এখন আর মনে নেই। তবে এটি মনে আছে হুমায়ুন আজাদ আসতেন এবং সম্রাটের মতো বসে থাকতেন আগামী প্রকাশনীতে।

একদিন আমি আর লেখক নাট্যকার শফিকুর রহমান শান্তনু হাঁটতে হাঁটতে আগামী প্রকাশনীর সামনে এসে দাঁড়াই। শান্তনু আর আমি কলেজে একই ক্লাসে পড়তাম। হুমায়ুন আজাদ ভেতরে একা বসে আছেন। শান্তনু সামনে যেতে সাহস পায় না। কীসের ভয় শান্তনুর?

— আমরা তো বই কিনব না! নেড়েচেড়ে চলে গেলে উনি যদি রাগ করেন? শান্তনু বলে!

— আরে চল, উনি রাগ করবেন না। কয়দিন আগে ওনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।

— কি বলিস? কোথায় কথা হলো?

— আরে এই মেলাতেই। ওনার অটোগ্রাফও নিয়েছি।

আমার কথায় শান্তনু কতটা ভরসা পেয়েছিল জানি না। তবে সেদিন আমরা হুমায়ুন আজাদের বই দেখে টেখে চলে এসেছিলাম। বই কিনব— টাকা কোথায় পকেটে!

একদিন এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর গাড়ি পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ভেতরে ঢুকে গেল। অটোগ্রাফ নেওয়ার সারি চলে গেল মেলা ছাড়িয়ে...। আমিও সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে যাই। পকেট হাতরে ২০০ টাকার মতো বের করতে পারি। তাই কিনে ফেলি হিমু সিরিজে বই— চলে যায় বসন্তের দিন। অটোগ্রাফ নিই বইয়ে।

তখনো ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হকের কিছুটা তারকাখ্যাতি ছিল। সুমন্ত আসলাম তারকা হয়ে উঠছিলেন। আমাদের যাদের ভেতরে তখন লেখার বাসনা— এই সব লেখকদের দেখি আর মনে মনে কিছুটা ঈর্ষা করি। আর ভাবি, সিরিয়াস সাহিত্য করে একদিন বদলে দেব সব!

মনে আছে, সেই কুড়ি বছর আগে, বাংলা একাডেমির বটতলা দিয়ে আলো-আঁধার সন্ধ্যায় হেঁটে যাচ্ছিলেন আসাদ চৌধুরী। একটু আগে কিনেছি তার ‘নদীও বিবস্ত্র হয়’— দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলাম, নাম বললাম, অটোগ্রাফ নিলাম। তিনি ব্যস্ত ছিলেন বলে দ্রুত চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, একদিন গল্প হবে। এরপর তাঁর...

১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। হারিয়ে যায় বাক্‌শক্তি। সে বছরই নজরুল হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্যও। ১৯৭২ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়।

উত্তরের বাতাস বয়। বটগাছের পাতায় ফরফর শব্দ হয়। একটা হলুদ পাতা ঝরে পড়ে মাথার ওপর। মনে মনে ভাবি মানুষের জীবনও তো এমন ঝরে পড়ার নিয়তি। তবে ঝরে যাওয়ার আগে কেউ কেউ পেয়ে যান অমরত্ব। তাদের আমরা বুকের মধ্যে বড় মমতায় পুষি!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত