অনলাইন ডেস্ক
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু জ্বালানি উৎপাদনের কোনো প্রকল্প নয়। এটি দেশটির ইতিহাস, আত্মপরিচয় এবং পশ্চিমা আধিপত্য থেকে মুক্তির এক প্রতীক। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যেভাবে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘সার্বভৌমত্ব’ ইরানি রাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় মননে গেঁথে গেছে, তাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ এই পরিচয়বোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
১৯৭৮ সালের অক্টোবর। তৎকালীন ইরানি শাহ সরকারের বিরোধী দুই নেতা— সেক্যুলার নেতা করিম সানজাবি এবং শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি প্যারিসের শহরতলি নফল-ল্য-শ্যাতোতে বৈঠকে বসেন। সেখানে বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের লক্ষ্য নির্ধারণে একটি খসড়া ঘোষণাপত্র তৈরি হয়। সানজাবির ভাষ্য অনুযায়ী, সেই ঘোষণায় ইসলাম ও গণতন্ত্রকে ভিত্তি হিসেবে রাখা হলেও খোমেনি নিজ হাতে তৃতীয় এক স্তম্ভ যোগ করেন— স্বাধীনতা।
এই ‘স্বাধীনতা’ মানেই ছিল বিদেশি প্রভাবমুক্ত একটি ইরান— বিশেষত পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদ মুক্ত একটি রাষ্ট্র। পরবর্তী চার দশকের ইতিহাসে এ কথাই বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ যখন প্রশ্ন তোলে, কেন ইরান নিজেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে, কেন তা রাশিয়া থেকে আমদানি করবে না— তখন ইরান বারবার জবাব দেয়— কারণ তারা স্বাধীন।
ইরান বারবার বলেছে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির অধিকার তাদের সার্বভৌম অধিকার। এই প্রশ্নেই ২০০০ সাল থেকে শুরু হওয়া পশ্চিমা-ইরান আলোচনার বারবার ভাঙন ধরেছে। অবশেষে ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত হয় যৌথ বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনায় ইরানকে ইউরেনিয়াম ৩.৬৭ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি, ইউরোপীয় দেশগুলোকেও ইরান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এতে ইরান মনে করে, আবারও তারা প্রতারিত হয়েছে।
ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একবার বলেছিলেন, ‘বিপ্লবের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো— এখন সব সিদ্ধান্ত তেহরানেই হয়।’
ইরানি-আমেরিকান শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ওয়ালি নসর তাঁর বই ‘ইরানস গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি’-তে লিখেছেন, ইসলামি বিপ্লবের অন্যান্য মূলনীতি যেমন— গণতন্ত্র বা ধর্মনীতি হয়তো আজ প্রশ্নবিদ্ধ, কিন্তু ইরানের স্বাধীনতা ও নিজস্ব নিয়ন্ত্রণের অধিকার আজও টিকে আছে। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই পারমাণবিক কর্মসূচিকে দেখা উচিত।
ইরান বর্তমানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে— যা ৯০ শতাংশে পৌঁছালেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট হবে। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা একে দেখছেন গোপন বোমা তৈরির ইঙ্গিত হিসেবে। কিন্তু তেহরান বলছে, এই উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধকরণ শুরু হয়েছে ট্রাম্পের চুক্তি ভাঙার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এটি ছিল একটি ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া— যাতে চাপে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র আবার আলোচনায় ফিরে আসে।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আচরণে ‘দ্বিমুখিতা’ দেখছে। ইসরায়েল নিজেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ, কিন্তু এনপিটিতে (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি) নেই, তবুও পশ্চিমাদের পূর্ণ সমর্থন পায়। অপরদিকে ইরান, যারা এনপিটির স্বাক্ষরকারী এবং ধর্মীয় ফরমান অনুযায়ী পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করেছে, তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার।
এর পেছনে রয়েছে এক গভীর ঐতিহাসিক ক্ষোভ। ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়, কারণ তিনি ইরানের তেলের ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন। ইরানিরা আজও বিশ্বাস করে, সেদিন থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব তাদের স্বার্থকে পদদলিত করে আসছে।
অতএব, ইরানের কাছে পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু শক্তি উৎপাদনের কোনো কৌশল নয়। এটি তাদের জাতীয় গৌরব, আত্মনির্ভরতা এবং ঐতিহাসিকভাবে অপমানিত জাতির পুনর্গঠনের এক প্রতীক।
তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য, ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়েছিল পশ্চিমা উদ্যোগে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় ‘Atoms for Peace’ কর্মসূচির আওতায় ১৯৭০-এর দশকে ইরানে ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল— প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে ইরানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ মাইকেল অ্যাক্সওয়ার্দি লিখেছেন, ‘তেল বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থকে এমন একটি অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করা, যা একবার তৈরি হলে ভবিষ্যতের জন্য অশেষ শক্তির উৎস হতে পারে— সেই সময় এটি ছিল সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত চিন্তা।’
কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর নতুন নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি পশ্চিমা প্রযুক্তিকে ‘ঘারবজাদেগি’ (পার্সি শব্দ) বা পশ্চিমাদের প্রতি আসক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে পরমাণু প্রকল্প স্থগিত করেন। খোমেনি বলেছিলেন, এই ধরনের বিশাল প্রকল্প ইরানকে পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর আরও নির্ভরশীল করে তুলবে। ফলে বুশেহরের মতো প্রায় সম্পন্ন চুল্লিগুলো নির্মাণাধীন অবস্থাতেই বন্ধ হয়ে যায়।
তবে কয়েক বছরের মধ্যেই বিদ্যুৎ সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইরান-ইরাক (১৯৮০-১৯৮৮) যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনে। ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের পর এবং বুশেহর স্থাপনায় ইরাকি বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিন্দা না পাওয়ায় ইরানে এক ধরনের ‘পারমাণবিক জাতীয়তাবাদ’ গড়ে ওঠে। তেহরানের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারেন, নিজেদের নিরাপত্তা এবং শক্তি নির্ভরতা নিশ্চিত করতে পরমাণু প্রযুক্তি অপরিহার্য।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির ভাষায়, ‘পারমাণবিক জ্বালানির পুরো চক্রে দক্ষতা অর্জন করা কেবল জ্বালানি বহুমুখীকরণ নয়— এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ।’
১৯৮০-৮৮ সাল পর্যন্ত যুদ্ধের সময় পার্লামেন্ট স্পিকার এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি পরমাণুবিজ্ঞানীদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি ইরানের সেবা না করেন, তবে কাকে করবেন?’ সেই সময় থেকেই গোপনে এই কর্মসূচি ফের চালু হয়।
রাফসানজানি পরবর্তীতে স্বীকার করেন, যুদ্ধের সময় ইরান প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়েছিল। যদিও তা কখনো বাস্তবে পরিণত হয়নি। তিনি পাকিস্তানে গিয়ে ড. আবদুল কাদির খানের সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা করেন। তিনিই পরবর্তীতে উত্তর কোরিয়া ও অন্য দেশকে পারমাণবিক প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করেছিলেন।
২০০২ সালে ইরানের দুটি গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র— নাতানজ ও কাশানের তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ইরান তখন জানায়— যেহেতু কেন্দ্রগুলো চালু হয়নি, তাই আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে (আইএইএ) জানানো বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব প্রশ্ন তোলে— যখন কোনো চালু চুল্লি নেই, তখন কেন এতখানি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার প্রয়োজন?
এরপর ২০০৩ সালের অক্টোবরে তেহরান ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইরান একটি চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়, যা আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে দেশটি পরিদর্শনের অনুমোদন দেয়। ২০০৪ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে আবারও সাময়িকভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থগিতে সম্মত হয় ইরান। কিন্তু জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য বলে, এটি আইনি বাধ্যবাধকতা নয়— বরং আস্থার নিদর্শন। অনেকেই মনে করেন, এই বিষয়টি ইরানিদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে।
২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসেন মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। তিনি ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেন, ‘পারমাণবিক প্রযুক্তি আমাদের তরুণদের বৈজ্ঞানিক অর্জন এবং আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতীক।’
জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার তৎকালীন প্রধান মোহাম্মদ এলবারাদেই তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায়, তা নয়— বরং তারা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়।’
২০১৩ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের একটি নিবন্ধে একই কথা বলেন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে পারমাণবিক খাতে দক্ষতা অর্জন শুধু জ্বালানি বহুমুখীকরণ নয়, এটি আমাদের জাতীয় মর্যাদা ও পরিচয়ের প্রতীক। যদি কেউ আমাদের পরিচয় এবং মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা না বোঝে, তবে এ সংকট কখনোই শেষ হবে না।’
তবে জাতীয় গৌরব রক্ষার এই কর্মসূচির মূল্য অনেক। নানান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে। বহু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। পরমাণু স্থাপনাগুলো বোমাবর্ষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আজকের ইরান এমন এক সংকটে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাষ্ট্র হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে— তারা পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেবল আত্মপরিচয়ের প্রতীক হিসেবে রাখবে, নাকি এর মাধ্যমে যুদ্ধের পথে যাবে।
তথ্যসূত্র: দা গার্ডিয়ান
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু জ্বালানি উৎপাদনের কোনো প্রকল্প নয়। এটি দেশটির ইতিহাস, আত্মপরিচয় এবং পশ্চিমা আধিপত্য থেকে মুক্তির এক প্রতীক। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যেভাবে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘সার্বভৌমত্ব’ ইরানি রাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় মননে গেঁথে গেছে, তাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ এই পরিচয়বোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
১৯৭৮ সালের অক্টোবর। তৎকালীন ইরানি শাহ সরকারের বিরোধী দুই নেতা— সেক্যুলার নেতা করিম সানজাবি এবং শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি প্যারিসের শহরতলি নফল-ল্য-শ্যাতোতে বৈঠকে বসেন। সেখানে বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের লক্ষ্য নির্ধারণে একটি খসড়া ঘোষণাপত্র তৈরি হয়। সানজাবির ভাষ্য অনুযায়ী, সেই ঘোষণায় ইসলাম ও গণতন্ত্রকে ভিত্তি হিসেবে রাখা হলেও খোমেনি নিজ হাতে তৃতীয় এক স্তম্ভ যোগ করেন— স্বাধীনতা।
এই ‘স্বাধীনতা’ মানেই ছিল বিদেশি প্রভাবমুক্ত একটি ইরান— বিশেষত পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদ মুক্ত একটি রাষ্ট্র। পরবর্তী চার দশকের ইতিহাসে এ কথাই বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ যখন প্রশ্ন তোলে, কেন ইরান নিজেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে, কেন তা রাশিয়া থেকে আমদানি করবে না— তখন ইরান বারবার জবাব দেয়— কারণ তারা স্বাধীন।
ইরান বারবার বলেছে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির অধিকার তাদের সার্বভৌম অধিকার। এই প্রশ্নেই ২০০০ সাল থেকে শুরু হওয়া পশ্চিমা-ইরান আলোচনার বারবার ভাঙন ধরেছে। অবশেষে ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত হয় যৌথ বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনায় ইরানকে ইউরেনিয়াম ৩.৬৭ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি, ইউরোপীয় দেশগুলোকেও ইরান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এতে ইরান মনে করে, আবারও তারা প্রতারিত হয়েছে।
ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একবার বলেছিলেন, ‘বিপ্লবের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো— এখন সব সিদ্ধান্ত তেহরানেই হয়।’
ইরানি-আমেরিকান শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ওয়ালি নসর তাঁর বই ‘ইরানস গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি’-তে লিখেছেন, ইসলামি বিপ্লবের অন্যান্য মূলনীতি যেমন— গণতন্ত্র বা ধর্মনীতি হয়তো আজ প্রশ্নবিদ্ধ, কিন্তু ইরানের স্বাধীনতা ও নিজস্ব নিয়ন্ত্রণের অধিকার আজও টিকে আছে। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই পারমাণবিক কর্মসূচিকে দেখা উচিত।
ইরান বর্তমানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে— যা ৯০ শতাংশে পৌঁছালেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট হবে। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা একে দেখছেন গোপন বোমা তৈরির ইঙ্গিত হিসেবে। কিন্তু তেহরান বলছে, এই উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধকরণ শুরু হয়েছে ট্রাম্পের চুক্তি ভাঙার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এটি ছিল একটি ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া— যাতে চাপে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র আবার আলোচনায় ফিরে আসে।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আচরণে ‘দ্বিমুখিতা’ দেখছে। ইসরায়েল নিজেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ, কিন্তু এনপিটিতে (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি) নেই, তবুও পশ্চিমাদের পূর্ণ সমর্থন পায়। অপরদিকে ইরান, যারা এনপিটির স্বাক্ষরকারী এবং ধর্মীয় ফরমান অনুযায়ী পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করেছে, তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার।
এর পেছনে রয়েছে এক গভীর ঐতিহাসিক ক্ষোভ। ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়, কারণ তিনি ইরানের তেলের ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন। ইরানিরা আজও বিশ্বাস করে, সেদিন থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব তাদের স্বার্থকে পদদলিত করে আসছে।
অতএব, ইরানের কাছে পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু শক্তি উৎপাদনের কোনো কৌশল নয়। এটি তাদের জাতীয় গৌরব, আত্মনির্ভরতা এবং ঐতিহাসিকভাবে অপমানিত জাতির পুনর্গঠনের এক প্রতীক।
তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য, ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়েছিল পশ্চিমা উদ্যোগে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় ‘Atoms for Peace’ কর্মসূচির আওতায় ১৯৭০-এর দশকে ইরানে ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল— প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে ইরানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ মাইকেল অ্যাক্সওয়ার্দি লিখেছেন, ‘তেল বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থকে এমন একটি অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করা, যা একবার তৈরি হলে ভবিষ্যতের জন্য অশেষ শক্তির উৎস হতে পারে— সেই সময় এটি ছিল সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত চিন্তা।’
কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর নতুন নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি পশ্চিমা প্রযুক্তিকে ‘ঘারবজাদেগি’ (পার্সি শব্দ) বা পশ্চিমাদের প্রতি আসক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে পরমাণু প্রকল্প স্থগিত করেন। খোমেনি বলেছিলেন, এই ধরনের বিশাল প্রকল্প ইরানকে পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর আরও নির্ভরশীল করে তুলবে। ফলে বুশেহরের মতো প্রায় সম্পন্ন চুল্লিগুলো নির্মাণাধীন অবস্থাতেই বন্ধ হয়ে যায়।
তবে কয়েক বছরের মধ্যেই বিদ্যুৎ সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইরান-ইরাক (১৯৮০-১৯৮৮) যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনে। ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের পর এবং বুশেহর স্থাপনায় ইরাকি বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিন্দা না পাওয়ায় ইরানে এক ধরনের ‘পারমাণবিক জাতীয়তাবাদ’ গড়ে ওঠে। তেহরানের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারেন, নিজেদের নিরাপত্তা এবং শক্তি নির্ভরতা নিশ্চিত করতে পরমাণু প্রযুক্তি অপরিহার্য।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির ভাষায়, ‘পারমাণবিক জ্বালানির পুরো চক্রে দক্ষতা অর্জন করা কেবল জ্বালানি বহুমুখীকরণ নয়— এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ।’
১৯৮০-৮৮ সাল পর্যন্ত যুদ্ধের সময় পার্লামেন্ট স্পিকার এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি পরমাণুবিজ্ঞানীদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি ইরানের সেবা না করেন, তবে কাকে করবেন?’ সেই সময় থেকেই গোপনে এই কর্মসূচি ফের চালু হয়।
রাফসানজানি পরবর্তীতে স্বীকার করেন, যুদ্ধের সময় ইরান প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়েছিল। যদিও তা কখনো বাস্তবে পরিণত হয়নি। তিনি পাকিস্তানে গিয়ে ড. আবদুল কাদির খানের সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা করেন। তিনিই পরবর্তীতে উত্তর কোরিয়া ও অন্য দেশকে পারমাণবিক প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করেছিলেন।
২০০২ সালে ইরানের দুটি গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র— নাতানজ ও কাশানের তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ইরান তখন জানায়— যেহেতু কেন্দ্রগুলো চালু হয়নি, তাই আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে (আইএইএ) জানানো বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব প্রশ্ন তোলে— যখন কোনো চালু চুল্লি নেই, তখন কেন এতখানি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার প্রয়োজন?
এরপর ২০০৩ সালের অক্টোবরে তেহরান ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইরান একটি চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়, যা আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে দেশটি পরিদর্শনের অনুমোদন দেয়। ২০০৪ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে আবারও সাময়িকভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থগিতে সম্মত হয় ইরান। কিন্তু জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য বলে, এটি আইনি বাধ্যবাধকতা নয়— বরং আস্থার নিদর্শন। অনেকেই মনে করেন, এই বিষয়টি ইরানিদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে।
২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসেন মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। তিনি ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেন, ‘পারমাণবিক প্রযুক্তি আমাদের তরুণদের বৈজ্ঞানিক অর্জন এবং আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতীক।’
জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার তৎকালীন প্রধান মোহাম্মদ এলবারাদেই তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায়, তা নয়— বরং তারা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়।’
২০১৩ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের একটি নিবন্ধে একই কথা বলেন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে পারমাণবিক খাতে দক্ষতা অর্জন শুধু জ্বালানি বহুমুখীকরণ নয়, এটি আমাদের জাতীয় মর্যাদা ও পরিচয়ের প্রতীক। যদি কেউ আমাদের পরিচয় এবং মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা না বোঝে, তবে এ সংকট কখনোই শেষ হবে না।’
তবে জাতীয় গৌরব রক্ষার এই কর্মসূচির মূল্য অনেক। নানান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে। বহু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। পরমাণু স্থাপনাগুলো বোমাবর্ষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আজকের ইরান এমন এক সংকটে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাষ্ট্র হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে— তারা পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেবল আত্মপরিচয়ের প্রতীক হিসেবে রাখবে, নাকি এর মাধ্যমে যুদ্ধের পথে যাবে।
তথ্যসূত্র: দা গার্ডিয়ান
কয়েক দশক ধরে বহু সংলাপ ও সংযমের করুণায় সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান। একের পর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এসেছেন, চলে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ এড়াতে তাঁরা ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক শক্তি ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন।
৮ ঘণ্টা আগে‘এই লোক বলেন এক কথা, করেন ঠিক আরেকটা’—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে বাংকার বাস্টার বোমা ফেলবেন কি না, তা নিয়ে যখন ব্যাপক গুঞ্জন; তখনই এ মন্তব্য করেন এক রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ট্রাম্পের কাজকর্মের ধরন সম্পর্কে তাঁর এ কথায় একমত লোকের অভাব হবে না, তা ভরসা নিয়েই বলা যায়। আর জনমনের সেই ধারণা সত্যি
১ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের রাতের বিমান হামলায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পুরো অঞ্চলজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইরান পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এই হামলার ‘চিরস্থায়ী পরিণতি’ হবে।
১ দিন আগেইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নিয়েছে। আর এই দ্বন্দ্বে চীনের অবস্থান হয়ে উঠছে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং এই সংকটে এমন এক কৌশলী অবস্থান নিয়েছে, যেখানে একদিকে ইরানের প্রতি কৌশলগত সমর্থন দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্কের সেতু ধরে
১ দিন আগে