Ajker Patrika

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের নিবন্ধ /এসপিওনাজ: যুদ্ধের মধ্যে ইরানের ভেতরে ইসরায়েলের আরেক যুদ্ধ

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ১৪: ২৩
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আকস্মিক বিমান হামলার পেছনে শুধু সামরিক তৎপরতা নয়, ছিল এক বিস্তৃত, বহুস্তরবিশিষ্ট গোয়েন্দা অপারেশনের জটিল নকশা। একটা সময় ছিল, যখন সামরিক অভিযান ছিল কেবলই সেনাবাহিনীর কাজ। কিন্তু আজ গোয়েন্দা, প্রযুক্তিবিদ, বেসরকারি উদ্যোগ ও গোপন চ্যানেল মিলিয়ে এক বিরাট ‘স্পাই ওয়ার’ চলছে। যেখানে প্রতিটি তথ্য, প্রতিটি ক্লু অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ব্যবহৃত হয়।

সবকিছু সূত্রপাত গত বছর। ইসরায়েলের এক উচ্চপদস্থ টেলিকম নির্বাহীর কাছে ফোনকল আসে তার এক পুরোনো বন্ধুর। তিনি তখন ইউরোপে। তাঁর বন্ধু তাঁকে বলেন, এমন একটি স্মার্টফোন ডিজাইন করতে যা দেখতে সস্তা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মতো হলেও গোপনে এনক্রিপ্টেড ডেটা প্রেরণ করতে পারে। ফোনটি যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেটওয়ার্কের মতো ট্রাফিক তৈরি করতে পারে, যাতে লক্ষ্যবস্তু তার উপস্থিতি বুঝতে না পারে।

একই সময়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক রিজার্ভ সৈন্যের কাছে আরেকটি টেলিফোন আসে ইউনিট ৯৯০০ থেকে। এই ইউনিট ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তথ্য বিশ্লেষণ বিভাগের এক ক্ষুদ্র কিন্তু অত্যন্ত দক্ষ ইউনিট, যা স্যাটেলাইট ছবি, যোগাযোগ তথ্য ও অন্যান্য ডেটা বিশ্লেষণ করে গোপন সংকেত খুঁজে বের করে। ইউনিটটি একটি স্বাস্থ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই রিজার্ভ সৈনিককে সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত একটি অ্যালগরিদমে পরিবর্তন আনতে নির্দেশ দেয়। পরিবর্তনটি হবে এমন যাতে একটি সার্ভার স্যাটেলাইট ছবি থেকে সহজেই বুঝতে পারবে কোন যানবাহন পেট্রোল বহন করছে আর কোনটি ক্ষেপণাস্ত্রের জ্বালানি।

এই দুই ঘটনাই স্পষ্ট করে দেয় যে, কেবল সেনাবাহিনীর ফিল্ড অপারেশন নয়, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও প্রযুক্তি উন্নয়নে কতটা গভীরভাবে কাজ করছে ইসরায়েল। দেশটির গোয়েন্দা সফলতার মূল চাবিকাঠি—তাদের বিস্তৃত স্পাই নেটওয়ার্ক। শুধু বাইরের শত্রুর কাছে নয়, অনেক সময় নিজেদের দেশের মধ্যে থাকা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কাছ থেকেও গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেশটি ইরানের অভ্যন্তরে হাজার হাজার সক্রিয় গুপ্তচর নিয়োগ করেছে। যারা হয় ইসরায়েলি সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভাড়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত, নয়তো রাজনৈতিক কারণে ইরানবিরোধী।

তবে এসবই সম্ভব হয়েছে মোসাদের সুনিপুণ নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে। গোয়েন্দাদের কৌশল ছিল—ইরানের স্থানীয় সমাজে ছড়িয়ে থাকা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা। তারপর অর্থ ও নিরাপত্তার বিনিময়ে তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নেওয়া। যাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার আছে, মূলত তাদেরই টার্গেট করে মোসাদ।

এক সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তা ইরানের ইসরায়েলের চলমান অভিযানকে বর্ণনা করেন ‘মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ও বহু বছরের প্রচেষ্টার ফল’ হিসেবে। তিনি বলেন, ‘যখন আপনি বহু বছর ধরে কাজ করেন। মানব গোয়েন্দা, ওপেন সোর্স গোয়েন্দা তথ্য, অর্থ, শ্রম—সবকিছু বিনিয়োগ করেন, তখন শেষ পর্যন্ত এ রকম একটা ফলাফলই পাওয়া যায়।’

শুধু জনবল নয়, প্রযুক্তিতেও ব্যাপক শক্তিশালী ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ২০২০ সালে ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর হামলা চালাতে মোসাদ ব্যবহার করেছিল রিমোট কন্ট্রোল মেশিনগান। মেশিনগানটি একটি অটোমেটেড ট্রাকে বসানো ছিল, কাজ শেষে যা নিজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়— মোসাদের ‘স্পাই ওয়ার’ কৌশল কতটা উন্নত।

মোসাদ ছাড়াও, ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আমানও ব্যাপক শক্তিশালী। আমানের তথ্যবিশ্লেষকেরা বহু বছর ধরে একটি ‘টার্গেট ব্যাংক’ গড়ে তুলছেন, যেখানে সংরক্ষিত আছে ইরানের কৌশলগত কেন্দ্র, যেমন—পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, শীর্ষ কমান্ডার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের তথ্য। হাজার হাজার ডেটা যাচাই-বাছাই করে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন— স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত চিত্রের বিশ্লেষণ, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ডাটা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে মোসাদ ও আমান তাদের টার্গেট শনাক্ত করে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে পর প্রায় প্রতিদিনই হিজবুল্লাহর তৎকালীন প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ কখন কোথায় থাকছেন সবই ট্র্যাক করতে পারত তারা। এবং এই ট্র্যাকিং প্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটাই ছিল স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া।

গত শুক্রবার (১৩ জুন) অপারেশন রাইজিং লায়ন শুরুর প্রথম কয়েক মিনিটেই ইসরায়েল ইরানের অন্তত ১৫টি উচ্চপর্যায়ের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এর মধ্যে ছিল ইরানের দুটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং শীর্ষ সামরিক কমান্ডারেরা। ইসরায়েলের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মিরি আইসিন বলেন, ‘এতগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে একসঙ্গে আঘাত করা খুবই কঠিন। এর মাধ্যমে আমরা প্রতিপক্ষের দ্রুত প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা বিলম্বিত করতে সক্ষম হয়েছি।’ এই হামলা ছিল ‘শক অ্যান্ড ও’ স্টাইলের, অর্থাৎ একসঙ্গে তীব্র ও বিস্তৃত আঘাত, যাতে শত্রুপক্ষ খুব দ্রুতই কুপোকাত হয়ে যায়।

এরপরই ইরানি কর্তৃপক্ষ মূলত ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তি এবং গোয়েন্দা তৎপরতার বিরুদ্ধে নড়েচড়ে বসেছে। ইরানি পুলিশ প্রধান আহমাদ রেজা রাদান প্রকাশ্যে বলেছেন, ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করা গুপ্তচরেরা যেন আত্মসমর্পণ করে, তাহলে তারা ‘ক্ষমা’ পাবেন। ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, মোবাইল ফোন কেবল নজরদারির নয়, হত্যাকাণ্ডেও ব্যবহার হচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ায় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন আপাতত বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে গোয়েন্দারা বলছেন, এখন এসব সতর্কতায় আর তেমন কোনো কাজ হবে না।।কারণ মোসাদের তৈরি সফটওয়্যার ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষ ব্যবহার করছে।

ইসরায়েলের এই সফলতা শুধু সামরিক বাহিনীর দক্ষতার ফল নয়, গোয়েন্দা ও তথ্য সংগ্রহে প্রযুক্তির সমন্বয় ও আধুনিকায়নের ফল। গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের মতে, মোসাদ ও আমানের এই একীভূত অপারেশন আধুনিক যুদ্ধের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে, যেখানে তথ্যের দখলই যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি। এক সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এর আগে এত বিস্তৃত গোয়েন্দা কার্যক্রম এমন সফলভাবে পরিচালিত হয়নি। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা, নেতৃত্বের চলাচল একেবারে নিখুঁতভাবে জানার ক্ষমতা আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।’

ইসরায়েলি এসপিওনাজ তৎপরতার বিপরীতে ইসরায়েলের ভেতরে ইরানি গোয়েন্দা তৎপরতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এখন পর্যন্ত কয়েকজন ইসরায়েলি নাগরিককে ইরানের হয়ে তথ্য সংগ্রহের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়ার এক আত্মীয়ের মোবাইল ফোন হ্যাক করে ইরানি হ্যাকাররা—এ ঘটনার দায় ইরান প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছে।

অন্যদিকে, ইরানের পাল্টা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে তাদের ইসরায়েলের হয়ে কাজ করার অভিযোগ এনেছে এবং সম্প্রতি এদের মধ্যে একজনকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ইসরায়েলির গ্রেপ্তারের তথ্য পাওয়া যায়নি, যা থেকে ধারণা করা যায়—ইসরায়েল হয়তো স্থানীয়দের বড় পরিসরে নিয়োগ দিচ্ছে, হয়তো অজান্তেই, কিংবা অর্থের বিনিময়ে, অথবা তারা এমন ব্যক্তিদের কাজে লাগাচ্ছে যারা ইরানি শাসনব্যবস্থার বিরোধী।

মোসাদ ইরানের পারমাণবিক আর্কাইভ থেকে হাজার হাজার গোপন নথিপত্র চুরি করে নিয়ে আসে, যা পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারে দেখান। এমনকি গত বছর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে আইডিএফের হামলায় নিহত হন তৎকালীন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া। ইরানি সরকারের একটি অতিথিশালায় অবস্থান করছিলেন তিনি। এমন একটি কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত স্থানে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে আইডিএফ, যা কৃতিত্ব পুরোপুরিভাবেই মোসাদের।

মোসাদের গোপনীয়তা ও রহস্যময়তা আরও বেড়েছে সম্প্রতি, যখন তারা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে তাদের কমান্ডোদের ইরানের ভেতরে কাজ করতে দেখা যায়। ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে তারা হামলা চালানোর ড্রোন ও গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ধ্বংস করে।

যুক্তরাষ্ট্রের এক সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘গোয়েন্দা দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে চমকপ্রদ সাফল্যগুলোর একটি—সম্পূর্ণ গোয়েন্দা দখল এবং প্রবেশাধিকার, সাম্প্রতিক সময়ে এমন উদাহরণ আর নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমন কোনো সংঘাতের কথা মনে করতে পারছি না যেখানে একটি পক্ষ এতটা বিস্তারিতভাবে তার প্রতিপক্ষের জরুরি পরিকল্পনা ও নেতৃত্বের চলাচলের ওপর দখল রাখতে পেরেছে।’

এই বিষয়ে সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মিরি আইসিন বলেন, সঠিকভাবে পরিচালিত হলে এবং পর্যাপ্ত সম্পদ থাকলে ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক ইউনিটগুলো কী করতে সক্ষম তা-ই বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক সাফল্যগুলো।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে ফাঁস দিলেন স্ত্রী

ইরানে ভূমিকম্প নিয়ে পারমাণবিক পরীক্ষার জল্পনা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

‘আমেরিকা যুদ্ধে জড়ালে ইরানের হাতে অনেক বিকল্প আছে’

‘ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যায় নয়, গুণে বিশ্বাসী ইরান, ইসরায়েল এবার আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখবে’

এবার আক্রমণের অগ্রভাগে ড্রোন, ইরানের ‘হাইব্রিড’ হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ ইসরায়েল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত