Ajker Patrika

আবের যেসব নীতিতে ক্ষুব্ধ ছিলেন জাপানিরা

আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২২, ১৮: ৩৫
আবের যেসব নীতিতে ক্ষুব্ধ ছিলেন জাপানিরা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন শিনজো আবে। আগ্রাসী বৈদেশিক নীতি এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক কৌশলের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি। তাঁর অর্থনৈতিক নীতি ‘অ্যাবেনোমিক্স’ নামে খ্যাতি পেয়েছিল।

একজন রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক হিসেবে শিনজো আবে তাঁর লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে (এলডিপি) দুইবার জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম কার্যকাল ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত। ২০০৬ সালে দায়িত্ব নিয়ে এক বছরের কিছু বেশি সময় ছিলেন। পুরো সময়টাই ছিল বিতর্কিত।

২০১২ সালে বিস্ময়করভাবে রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘটে আবের। এরপর টানা ২০২০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। পরে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি।

জাপানে ভয়ানক মন্দার মধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেন শিনজো আবে। তাঁর অর্থনৈতিক নীতি—আর্থিক সহজীকরণ, রাজস্ব প্রণোদনা এবং কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। এসব কারণে একটি দুর্বল অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া হয়।

 ২০১১ সালে তোহোকুতে বিধ্বংসী ভূমিকম্প এবং সুনামি থেকে জাপানের পুনরুদ্ধারের তত্ত্বাবধান করেছিলেন আবে। এই দুর্যোগে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এই ভূমিকম্পের কারণেই ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সমুদ্রে তেজস্ক্রিয় পানির বিস্তার নিয়ে সারা বিশ্বেই উদ্বেগ দেখা দেয়।

 ২০২০ সালে কয়েক সপ্তাহের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগের কথা বলে পদত্যাগ করেন আবে। অন্ত্রের রোগের কারণে ২০০৭ সালেও পদত্যাগ করেছিলেন তিনি।

আবের স্থলাভিষিক্ত হন ঘনিষ্ঠ দলীয় মিত্র ইয়োশিহিদে সুগা। কিন্তু এরপরও জাপানের রাজনীতিতে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনিই ছিলেন।

শিনজো আবে জাপানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিনতারো আবের ছেলে। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী নোবুসুকে কিশির নাতি। ফলে তাঁকে বলা যেতে পারে রাজনৈতিক রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী।

১৯৯৩ সালে আবে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি তাঁকে প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।

২০০৬ সালে জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন শিনজো আবে। এর পরপরই জাপানের শীর্ষ ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে দ্রুতই উত্থান ঘটে তাঁর।

কিন্তু ধারাবাহিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আবেকে বেশ চাপে ফেলে। রেকর্ড পরিমাণ পেনশন সুবিধা ছাঁটাই করে তাঁর সরকার। এতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ বিপাকে পড়ে। এই সিদ্ধান্ত তাঁর প্রশাসনের জন্য বড় ধরনের আঘাতের কারণ হয়।

২০০৭ সালের জুলাই মাসে উচ্চকক্ষের নির্বাচনে এলডিপি বড় ধাক্কা খায়। সে বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগের কারণে পদত্যাগ করেন। কিন্তু ২০১২ সালে আবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে এসে বলেন, কোনো ধরনের অস্ত্রোপচার ছাড়াই শুধু ওষুধ সেবনে রোগটি কাটিয়ে উঠেছেন।

২০১৪ এবং ২০১৭ সালে আবে আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই ধারাবাহিক বিজয় তাঁকে জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রিত্ব এনে দেয়।

শিনজো আবের নীতির কারণেই জনপ্রিয়তা বেশ ওঠানামা করেছে। কিন্তু এলডিপিতে তাঁর প্রভাব তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় পরিণত করে। এমনকি দলের নেতা হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পেতে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়।

আগ্রাসী প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র নীতির কারণে পরিচিত ছিলেন শিনজো আবে। দ্বিতীয় যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের শান্তিবাদী সংবিধান সংশোধন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন তিনি। জাপানের সেনাবাহিনীকে বলা হয় সেলফ ডিফেন্স ফোর্স। সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে একটি ধারায় বলা আছে, বিশ্বশান্তির জন্য যুদ্ধ বেআইনি। জাপানের যে সশস্ত্র বাহিনী তারা মূলত অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করবে। এ বাহিনীতে ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং পরমাণু অস্ত্রের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যুদ্ধ নয় বিশ্বে শান্তি স্থাপিত হবে ন্যায় ও শৃঙ্খলার মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালের ৩ মে এ সংবিধান কার্যকর হয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই এ সংবিধান গ্রহণ করতে বাধ্য হয় জাপান সরকার।

জাপানের রক্ষণশীলেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবে প্রণীত এ সংবিধান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাদের অপমানজনক পরাজয়ের স্মারক।

আবের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালে টোকিওর ইয়াসুকুনি সমাধিক্ষেত্র পরিদর্শনে যাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধের সময়কার জাপানের সামরিকবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত একটি বিতর্কিত সমাধিক্ষেত্র এটি।

বারবার এই সমাধি পরিদর্শন জাপানের বামপন্থী দলগুলোকেও বেশ বিব্রত করেছে। বামপন্থীরা প্রধানমন্ত্রীর এমন আচরণকে যুদ্ধের সময় জাপানি নৃশংসতাকে অনুমোদন দেওয়ার একটি চেষ্টা হিসেবে দেখেছে।

২০১৫ সালে শিনজো আবে ‘সম্মিলিত আত্মরক্ষার’ অধিকারের জন্য সংবিধান সংশোধনের চাপ দেন। বৈদেশিক আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষা এবং মিত্রদের রক্ষার জন্য নিজ ভূখণ্ডের বাইরে জাপানি সেনা মোতায়েনের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন তিনি।

জাপানের প্রতিবেশী দেশ এবং এমনকি জাপানি জনসাধারণের বিরোধিতা সত্ত্বেও জাপানের সংসদ এই বিতর্কিত সংবিধান সংশোধন বিল পাস করে। 

অবশ্য শিনজো আবের জাপানের সামরিক বাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধন করার বৃহত্তর লক্ষ্য অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। আবের এই পদক্ষেপ এখনো জাপানে একটি বিতর্কিত জাতিকে বিভক্তকারী ইস্যু হিসেবে রয়ে গেছে।

এ ছাড়া বিরোধপূর্ণ দ্বীপমালা যেটিকে জাপান বলে ‘উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চল’—সেটি নিয়ন্ত্রণ ফেরাতেও সক্ষম হননি শিনজো আবে। হোক্কাইদোর উত্তর প্রিফেকচারের কাছে এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান। জাপান এবং রাশিয়া উভয়ই এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শিনজো আবের সম্পর্কও এখানে উল্লেখযোগ্য। বাণিজ্য শুল্কের চাপে পড়া মার্কিন অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেই সঙ্গে জাপানে মার্কিন সেনা উপস্থিতি সমর্থনের জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কৃতিত্বও তাঁকে দেন ট্রাম্প। যদিও ওকিনাওয়া দ্বীপে মার্কিন সেনাদের হাতে স্থানীয় অধিবাসীদের নিপীড়ন এমনকি ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

 ২০১৯ সালের অক্টোবরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উদারীকরণের লক্ষ্যে দুটি বাণিজ্য চুক্তি করে। চুক্তির আওতায় পণ্যে প্রবেশাধিকার সহজ, কোটা সম্প্রসারণ এবং ট্যারিফ কমানো হয়।

অর্থনীতিতে আবের সিগনেচার নীতি ‘আবেনোমিক্স’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এই নীতি তাঁর প্রথম মেয়াদে জাপানকে প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসতে সহায়তা করেছিল।

নীতির মধ্যে অন্যতম—স্বল্পমেয়াদি ঋণাত্মক সুদের হার। এ নীতি ভোক্তা এবং কোম্পানিগুলোর জন্য ঋণ নেওয়া এবং খরচ করা সহজ করে তোলে। অবকাঠামোতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি এবং কর বিরতির মতো আরও আর্থিক প্রণোদনা এবং সংস্কার আরও বেশি নারীকে কর্মশক্তিতে যুক্ত করেছিল। জনবল সংকট কমাতে এবং নতুন উদ্যোগ উৎসাহিত করতে অভিবাসীদের উৎসাহিত করেছিল আবেনোমিক্স।

কিন্তু তাঁর এ প্রচেষ্টা বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় যখন ২০২০ সালের বসন্তে জাপান আবার মন্দার মুখে পড়ে। আগের ও পরের মন্দা আবের এই নীতি কৌশলের কার্যকারিতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে।

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা নিয়ে সারা দেশে উদ্বেগের কারণে আবের জনপ্রিয়তা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমালোচকেরা মনে করেন, অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাড়ানোর লক্ষ্যে আবের প্রচারণাগুলো নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।

সমালোচকেরা আরও বলেন, অ্যাবেনমিক্সের অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে—কর্মক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন, স্বজনপ্রীতি প্রতিরোধ এবং অস্বাস্থ্যকর কাজের সংস্কৃতি পরিবর্তন—এসব অধরাই রয়ে গেছে।

পদত্যাগ এবং মৃত্যু
২০২০ সালের ২৮ আগস্ট আবের পদত্যাগের ঘোষণা এলডিপিকে অভ্যন্তরীণ বিরোধের দিকে ঠেলে দেয়। এরপরও আবে তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম বলতে অস্বীকার করেন। অবশেষে প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং দীর্ঘদিনের মন্ত্রিসভার সদস্য ইয়োশিহিদে সুগা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।

কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাকে এলডিপিতে সুগার স্থলাভিষিক্ত করার পরও শিনজো আবে জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন।

শুক্রবার (৮ জুলাই) দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নারাতে জাপানের উচ্চকক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন আবে। বক্তৃতা দেওয়ার সময় একজন বন্দুকধারী তাঁকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি করে। ৪১ বছর বয়সী ওই হামলাকারী জাপানের স্ব-প্রতিরক্ষা বাহিনীর (জাপানের সামরিক বাহিনী) সাবেক সদস্য বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বাহিনী থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।

হাসপাতালে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর শিনজো আবে মারা যান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ভারত: ব্রিটিশ বিশ্লেষক

পুরোনো রাউটার ফেলে না দিয়ে যে কাজে ব্যবহার করতে পারেন

পোশাকের পর অস্ত্র প্রশিক্ষণও পাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত এডিরা

প্রথম ভাষণে গাজা প্রসঙ্গে যা বললেন পোপ লিও চতুর্দশ

গ্যাসের চুলা থেকে ছড়ায় বেনজিন, ক্যানসারসহ নানা রোগের ঝুঁকি: গবেষণা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত