Ajker Patrika

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার যে সবক পেলেন মোদি ও তাঁর দল

দ্য ওয়্যার
আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ০০: ১১
জয়পুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমাবেশে বিজেপি সমর্থকেরা। ছবি: পিটিআই
জয়পুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমাবেশে বিজেপি সমর্থকেরা। ছবি: পিটিআই

‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং এর সেনাবাহিনী আমাদের সাংবিধানিক মূল্যবোধের এক অপূর্ব প্রতিচ্ছবি।’ ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। যুদ্ধের গর্জন স্তিমিত হয়ে এলেও তাঁর এই বক্তব্য বহুদিন ধরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে। তাঁর এই বক্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ভারতের শাসক দল বিজেপি ও তাদের মূল আদর্শিক সংগঠন আরএসএস যুদ্ধ পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক উসকানি প্রচারে ব্যস্ত। অথচ কর্নেল কুরেশির কথাই মনে করিয়ে দেয়, পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র প্রকৃত ভিত্তি হলো—ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা।

যুদ্ধ এড়ানো গেছে, দুই পক্ষই নিজ নিজ জনগণকে বলছে, তারা বিজয়ী। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময়ই তেতো।

এ ক্ষেত্রে আদর্শিকভাবে পরাজিত হয়েছে ভারতের শাসক দল বিজেপি ও তাদের ভাবাদর্শ। শুধু যুদ্ধের মাঠে নয়, আদর্শের ময়দানেও হেরে গেছে তারা। কারণ, ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব এ জন্য নয় যে দেশটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বরং এ জন্য যে ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে।

সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় যখন রাজনৈতিক নেতারা প্রায় নীরব ছিলেন, তখন পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি, কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং যা বলেছেন, তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও শান্তিপূর্ণ সুরে; বিশেষ করে কুরেশি যখন পাকিস্তানের অভিযোগের জবাবে বলেন, ‘ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ’—তখন তিনি স্পষ্ট করে দেন, ‘ভারতের সেনাবাহিনী ধর্মীয় স্থান বা প্রতীক আক্রমণ করতে পারে না।’

এই বক্তব্য শুধু পাকিস্তান নয়, বরং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের জন্যও। এমনকি তাঁদের সমর্থকেরাও—যাঁরা ২০১৪ সাল থেকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদলে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

বিজেপির আদর্শগত অবস্থান শুরু থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালে জয়ের পর ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি ২০১৪-এর পর হারিয়ে গেছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি সবচেয়ে বড় মিথ্যা। ২০২৩ সালে সংসদে সংবিধানের যে কপি বিতরণ করা হয়, সেখান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়। বারবার আদালতেও এই শব্দ বাদ দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি পদে থাকা জগদীপ ধনখড়ও বারবার বলেছেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তনীয় নয়, যদিও সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান হলো, মৌলিক কাঠামো অগ্রাহ্য করে কোনো আইন পাস করা যায় না। আর এই কাঠামোর অন্যতম স্তম্ভই হলো ধর্মনিরপেক্ষতা।

বিজেপির আদর্শিক গুরুগণ, বিশেষত গোলওয়ালকার ও দীনদয়াল উপাধ্যায় বারবার বলেছেন, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত নয়। আরএসএস যে ধরনের ‘সংস্কৃতি’তে বিশ্বাস করে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার আধিপত্যই চূড়ান্ত সত্য।

ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অর্থ হলো, সব ধর্মের মানুষ সমান রাজনৈতিক অধিকার পাবেন। কেবল ভোট দেওয়ার অধিকার নয়, প্রতিনিধিত্বের অধিকারও। কিন্তু বিজেপি নেতারা বারবার মুসলিম নেতাদের সম্ভাব্য নেতৃত্বকে ভয়ের অস্ত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন। যেমন মোদি গুজরাটে বলেছেন, ‘কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে আহমেদ পটেল মুখ্যমন্ত্রী হবেন!’ এটি যেন ভীতিকর কিছু। আসামেও বলা হয়েছিল, বিজিপি না জিতলে বদরুদ্দিন আজমল মুখ্যমন্ত্রী হবেন। এসব কথায় প্রশ্ন তোলা হয়নি, মুসলিমরা কেন নেতৃত্ব দিতে পারবেন না?

২০০২ সালে, নির্বাচনের সময় স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিলে মোদি নির্বাচন কমিশনার জে এম লিংডোর খ্রিস্টান পরিচয়ে তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘জেমস মাইকেল লিংডো—তিনি এমনভাবে এই কথা বলেন, যেন এটি তাঁর পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের কারণ।

সোনিয়া গান্ধীর খ্রিস্টান পরিচয়ও বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে বারবার।

২০১৪ সালের পর বিজেপি সমর্থকেরা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (secular) শব্দটিকে ব্যঙ্গ করে ‘সিক’ (sick) শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে ‘sickular’ মানে অসুস্থ বলে ট্রল করতে শুরু করে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিচয় সব ধর্মের মানুষের জন্য অংশগ্রহণমূলক হতে পারে না। অথচ, এক দশক ধরে মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলার লক্ষ্যে পাঠ্যবই, শহরের নাম, ইতিহাস—সবকিছুর হিন্দুকরণ চলছে।

যাঁরা বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমা ধারণা, তাঁদের প্রশ্ন করা যায়, তাহলে আজ আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের যে মুখটি দেখাতে হয়, সেটি ধর্মনিরপেক্ষতারই মুখোশ নয় কি? ভারত কি আজ সেই ধর্মনিরপেক্ষতার আশ্রয় নিচ্ছে, যার বিরুদ্ধে তারা দশকের পর দশক লড়েছে?

লেখক: অধ্যাপক অপূর্বানন্দ ঝা (দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়)

অনুবাদ: জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়: ফেসবুকে বাকের মজুমদার

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় এক দিনে ১০০ ডলার কমল সোনার দাম

যুদ্ধ বলিউডের সিনেমা নয়: ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান

কঠোর হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি, স্থায়ী বসবাসের আবেদনে অপেক্ষা ১০ বছর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত